পাতা:বঙ্গ গৌরভ - জলধর সেন.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Συ বঙ্গ-গৌরব বসিয়া থাকিতে দেখা যাইত। অনেকে এই জন্যই মনে করিতেন। তঁহার বুদ্ধি বিশেষ তীক্ষ্ণ হইবে না ; চলতি কথায় যাহাকে হাঁদারাম বলে, বড় হইলেও তিনি সেই হাঁদারামই থাকিয়া যাইবেন। তঁহাদের এ ধারণা পরবর্তীকালে যে মিথ্যা হইয়াছিল, আজ আর তাহা কাহাকেও বলিয়া দিবার আবশ্যক হয় না। এই শিশু-বয়সেই কেশবচন্দ্রের যে গুণটি বিশেষভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিত, তাহা তাহার নিভীকতা। ভয় কাহাকে বলে তাহা যেন তিনি জানিতেনই না। কেহ কোন বিষয় লইয়া ভয় দেখাইলে সেই জিনিসটার জন্যই তাহার জেদ আরও বাড়িয়া যাইত। এই সাহস তাহার জীবনকে চিরদিন সত্যের পথে ধরিয়া রাখিয়াছিল। যে সব খেলাসঙ্গী তাহার সংস্পর্শে আসিয়াছে তাহারা তাহার আধিপত্য স্বীকার না করিয়া পারে নাই। কেশবচন্দ্ৰ পাড়ার ছেলেদের সর্দার ছিলেন। কিন্তু সর্দার হইলেও তঁহার দ্বারা কখনও কাহারও অন্যায় সাধিত হয় নাই। বাড়ির কর্তাদের অনুকরণে ছেলেদের লইয়া তিনি সংকীর্তনেব দল গঠন করিয়াছিলেন। তাহারা কপালে চন্দনের ফোটা কাটিয়া, হরি হরি’ বলিয়া গান ও নৃত্য করিত। কেশবচন্দ্র তাহাদিগকে গুরুজনের কথা শুনিতে, পশুপক্ষী সকলের প্রতি সদয় ব্যবহার করিতে, ভগবানকে ডাকিতে শিক্ষণ দিতেন। এইরূপে জীবনের প্ৰভাতেই তিনি সংস্কারকের ব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন। কলিকাতায় এখন যেখানে এলবার্ট হল” স্থাপিত হইয়াছে, সেইখানে একটি ছোট রকমের পাঠশালা ছিল। এই পাঠশালাতে কেশবচন্দ্রের বিদ্যারম্ভ হয়। পড়াশুনায় কেশবচন্দ্রের মনোযোগের অভাব ছিল না। সুতরাং গুরুমহাশয় অল্পদিন পরেই তাঁহাকে “সর্দার পড়ো” করিয়া দিলেন। কিন্তু, এখানে অধিক দিন থাকা তাহার। চলিল না। ইংরেজি শিখিবার জন্য তিনি শীঘ্রই হিন্দু স্কুলে ভরতি হইলেন। এখানেও অল্পদিনের মধ্যেই তাহার কৃতিত্ব ছাত্র এবং শিক্ষক সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। কেশবচন্দ্ৰ ছাত্র হিসাবে অসাধারণ কোনো প্ৰতিভার পরিচয় দিতে পারেন নাই। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে তাহার পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান আশাতিরিক্ত হইলেও অঙ্কশাস্ত্ৰে তীহার মাথা একেবারেই খেলিত না। সুতরাং তঁহাকে কলেজ ছাড়িয়া দিতে হইল। কিন্তু কলেজ ছাড়িলেও পড়াশুনা বা জ্ঞান-চৰ্চা তঁহাকে পরিত্যাগ করিল না। নিভৃতে। অনন্যমনে দুরূহ ও জটিল গ্রন্থসমূহ লইয়া তিনি জ্ঞানালোচনার ভিতর ডুবিয়া গেলেন। ইহার ফলে বড় বড় পণ্ডিতদের লেখা ও চিন্তার ধারার সহিত তাহার পরিচয় যেমন একান্ত সহজ হইয়া উঠিল, তেমনি তঁহার নিজের চিস্তাশীলতাও অসাধারণ বাড়িয়া গেল। ভগবানের প্রতি অনুরাগ কেশবচন্দ্রের রক্তের সঙ্গে মিশিয়া ছিল। তাই বয়স বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে ভগবানের কাছে আত্মনিবেদনের আকুলতাও তাহার বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। এই আত্মনিবেদনের আকুলত হইতেই প্রার্থনার পদ্ধতি সম্বন্ধে তাঁহার চিস্তা নূতন পথ ধরিয়া বহিতে শুরু করিল। তিনি সকলের কাছে তাহার প্রাণের কথা খুলিয়া বলিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। পাছে অশিক্ষিত লোক তঁহার কথা বুঝিতে না পারে, এই নিমিত্ত ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলুটােলায় একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিলেন।