পাতা:বাংলায় ভ্রমণ -দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/১২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(গ) ব্যাণ্ডেল—বারহাড়োয় লুপ শাখা। বংশবাটী—হাওড়া হইতে ২৮ ও ব্যাণ্ডেল জংশন হইতে ৩ মাইল দূর। এই স্থানের চলিত নাম বঁাশবেড়ে। রায় মহাশয় উপাধিধারী এখানকার প্রাচীন জমিদার বংশের জন্য এই স্থানের প্রসিদ্ধি। এই বংশের আদিপরুষের নাম রামেশ্বর রায়চৌধুরী। তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিকট হইতে “রাজা মহাশয় " উপাধি লাভ করেন। সেই হইতে তাহার বংশধরগণ রায় মহাশয় নামে খ্যাত। রাজা মহাশয়গণের গড়-বেষ্টিত বাট এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য। এই গড়ের মধ্যে বাসুদেব স্বয়ম্বরা কালী, সুপ্রসিদ্ধ হংসেশ্বরী, ও চতুৰ্দ্দশেশুরের মন্দির অবস্থিত। হংসেশ্বরীর মন্দিরের অনুরূপ মন্দির বাংলাদেশে আর একটিও নাই। ছয়তল ও ত্রয়োদশ চূড়া সমন্বিত ৭০ ফুট উচচ এই মন্দিরটি বারাণসীর স্থাপত্য শিল্পের আদর্শে নিৰ্ম্মিত। ইহার গঠন প্রণালীতে যৌগিক ঘটুচক্রভেদের রহস্য উদঘাটিত হইয়াছে। নরদেহে ষট চক্রভেদের ইড়া, পিঙ্গলা, সুমুয়া, বজাক্ষ ও চিত্ৰিনী নামে যে পচাট নাড়ী আছে, সেরূপ এই মন্দিরে উহাদের প্রতীক পাঁচটি সোপান আছে এবং হংসেশ্বরী দেবী কুলকুণ্ডলিনী রূপে অবস্থিত। বাঁশবেড়িয়ার রাজা নৃসিংহদেব এই মন্দিরের নির্মাণ আরম্ভ করেন এবং তৎপত্নী রাণী শঙ্করীদেবী কর্তৃক ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে ইহা সম্পন্ন হয়। এই মন্দির নির্মাণে আনুমানিক ৫ লক্ষ টাকা ব্যয়িত হইয়াছিল। লুপ্ত বিষয় উদ্ধারের উদ্দেশ্যে রাজা নৃসিংহদেব ব্যয় সঙ্কোচের জন্য রাজধানী বংশবাটী হইতে কাশীতে গিয়া বাস করিতেছিলেন। সেখানে কাশীখণ্ডের বঙ্গানুবাদে তিনি খিদিরপুর ভূকৈলাসের রাজা জয়নারায়ণ ঘোষালকে বিশেষ সাহায্য করেন এবং স্বয়ং “উদিশতন্ত্রের ” বঙ্গানুবাদ করেন। শাস্ত্রীলোচনা ও যোগসাধনার ফলে নৃসিংহদেবের বিষয় বাসনা তিরোহিত হইয়া যায় এবং সংগৃহীত অর্থ মামলা-মোকদ্দমায় ব্যয় না করিয়া হংসেশ্বরী দেবীর মন্দির নির্মাণে তিনি উহা ব্যয় করেন। হংসেশ্বরী দেবীর প্রতিমূৰ্ত্তি নিমকাঠের দ্বারা প্রস্তুত দেবীর বর্ণ নীল, শবরূপী শিবের নাভিপদ্মের উপর দেবী উপবিষ্ট । মন্দিরের দক্ষিণ অর্থাৎ সন্মুখভাগের বারান্দায় ১২টি কারুকার্য্যখচিত খিলান আছে। মধ্যভাগের চূড়াটি প্রায় ৭০ ফুট উচচ । মন্দিরের ছাদে উঠবার জন্য তিনটি সিড়ি আছে। ছাদের উপর হইতে অদূরবর্তী গঙ্গার দৃশ্য অতি সুন্দর দেখায়। বাসুদেব মন্দিরটি বাঁশবেড়িয়ার মধ্যে সবর্বাপেক্ষা প্রাচীন। ইহা ১৬৭৯ খৃষ্টাব্দে নিৰ্ম্মিত হয়। এই মন্দিরের ছাদে একটি বড় গুম্বজ আছে এবং সমুখ ভাগের প্রাচীর গাত্রে ইষ্টকের উপর বহু পৌরাণিক চিত্র উৎকীর্ণ আছে। প্রাচীন বাংলার শিল্প-নিদর্শন হিসাবে ইহাও একটি দ্রষ্টব্য বস্তু | বংশবাটী এক সময়ে সংস্কৃত চচর্চার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল এবং এখানে বহু পণ্ডিতের জন্ম হইয়াছিল। পূবেৰ্ব এখানে নীলের চাষ হইত। মুসাহিত্যিক দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ নাটকে বর্ণিত নীলকুঠি বঁাশবেড়েয় অবস্থিত ছিল। - পরলোকগত প্রসিদ্ধ সমাজ সংস্কারক হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মহাশয় বংশবাটীর অধিবাসী ছিলেন। ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে কলিকাতার তত্ত্ববোধিনী সভা এখানে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন; বিদ্যালয়ের ছাত্রের বেদান্তের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িলে বহু অভিভাবক ছাত্রদের বিদ্যালয় হইতে ছাড়াইয়া লন। বিদ্যালয়টি পরে উঠিয়া যায়।