আনন্দমঠ (১৮৮৩)/প্রথম খণ্ড/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।

 ব্রহ্মচারীর গান অনেকে শুনিয়াছিল। অন্যান্য লোকের মধ্যে জীবানন্দের কাণে সে গান গেল। মহেন্দ্রের অনুবর্ত্তী হইবার তাহার প্রতি আদেশ ছিল, ইহা পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে। পথিমধ্যে একটি স্ত্রীলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছিল। সে সাত দিন খায় নাই, রাস্তার ধারে পড়িয়াছিল। তাহার জীবনদান জন্য জীবানন্দ দণ্ড দুই বিলম্ব করিয়াছিলেন। মাগীকে বাঁচাইয়া তাহাকে অতি কদর্য ভাষায় গালি দিতে দিতে (বিলম্বের অপরাধ তার) এখন আসিতেছিলেন। দেখিলেন, প্রভুকে মুসলমানে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে—প্রভু গান গায়িতে গায়িতে চলিয়াছেন।

 জীবানন্দ মহাপ্রভু সত্যানন্দের সঙ্কেত সকল বুঝিতেন।

“ধীরসমীরে,     তটিনীতীরে,
বসতি বনে বরনারী”

 নদীর ধারে আবার কোন মাগী না খেয়ে পড়িয়া আছে না কি? ভাবিয়া চিন্তিয়া, জীবানন্দ নদীর ধারে ধারে চলিলেন। জীবানন্দ দেখিয়াছিলেন যে, ব্রহ্মচারী স্বয়ং মুসলমান কর্ত্তৃক নীত হইতেছেন। এস্থলে, ব্রহ্মচারীর উদ্ধারই তাঁহার প্রথম কাজ। কিন্তু জীবানন্দ ভাবিলেন, “এ সঙ্কেতের সে অর্থ নয়। তাঁর জীবনরক্ষার অপেক্ষাও তাঁহার আজ্ঞাপালন বড়—এই কথাই তাঁহার কাছে প্রথম শিখিয়াছি। অতএব তাঁহার আজ্ঞাপালনই করিব।”

 নদীর ধারে ধারে জীবানন্দ চলিল। যাইতে যাইতে সেই বৃক্ষতলে নদীতীরে দেখিল যে এক স্ত্রীলোকের মৃতদেহ আর এক জীবিতা শিশুকন্যা। পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে, মহেন্দ্রের স্ত্রী কন্যাকে জীবানন্দ একবারও দেখেন নাই। মনে করিলেন, হইলে হইতে পারে যে ইহারাই মহেন্দ্রের স্ত্রী কন্যা। কেন না প্রভুর সঙ্গে মহেন্দ্রকে দেখিলাম, তাহার স্ত্রী কন্যা দেখিলাম না। যাহা হউক মাতা মৃতা, কন্যাটী জীবিতা। আগে ইহার রক্ষাবিধান করা চাই—নহিলে বাঘ ভালুকে খাইবে। ভবানন্দ ঠাকুর এইখানেই কোথায় আছেন, তিনি স্ত্রীলোকটীর সৎকার করিবেন, এই ভাবিয়া জীবানন্দ বালিকাকে কোলে তুলিয়া লইয়া চলিলেন।

 মেয়ে কোলে তুলিয়া জীবানন্দ গোঁসাই সেই নিবিড় জঙ্গলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। জঙ্গল পার হইয়া একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে প্রবেশ করিলেন। গ্রামখানির নাম ভৈরবীপুর। লোকে বলিত ভরুইপুর। ভরুইপুরে কতকগুলি সামান্য লোকের বাস, নিকটে আর বড় গ্রাম নাই, গ্রাম পার হইয়াই আবার জঙ্গল। চারিদিকে জঙ্গল—জঙ্গলের মধ্যে একখানি ক্ষুদ্র গ্রাম, কিন্তু গ্রামখানি বড় সুন্দর। কোমলতৃণাবৃত গোচারণভূমি, কোমল শ্যামল পল্লবযুক্ত আম, কাঁটাল, জাম, তালের বাগান, মাঝে নীলজলপরিপূর্ণ স্বচ্ছ দীর্ঘিকা। তাহাতে জলে বক, হংস, ডাহুক; তীরে কোকিল, চক্রবাক; কিছু দূরে ময়ূর উচ্চরবে কেকাধ্বনি করিতেছে। গৃহে গৃহে, প্রাঙ্গণে গাভী, গৃহের মধ্যে মরাই, কিন্তু আজ কাল দুর্ভিক্ষে ধান নাই—কাহারও চালে একটী ময়নার পিঁজরে, কাহারও দেওয়ালে আলিপনা—কাহারও উঠানে শাকের ভূমি। সকলই দুর্ভিক্ষপীড়িত, কৃশ, শীর্ণ, সন্তাপিত। তথাপি এই গ্রামের লোকের একটু শ্রীছাঁদ আছে—জঙ্গলে অনেক রকম মনুষ্যখাদ্য জন্মে, এজন্য জঙ্গল হইতে খাদ্য আহরণ করিয়া সেই গ্রামবাসীরা প্রাণ ও স্বাস্থ্য রক্ষা করিতে পারিয়াছিল।

 একটী বৃহৎ আম্রকানন মধ্যে একটী ছোট বাড়ী। চারিদিকে মাটীর প্রাচীর, চারিদিকে চারিখানি ঘর। গৃহস্থের গোরু আছে, ছাগল আছে, একটা ময়ূর আছে, একটা ময়না আছে, একটা টিয়া আছে। একটা বাঁদর ছিল, কিন্তু সেটাকে আর খাইতে দিতে পারে না বলিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে। একটা ঢেঁকি আছে, বাহিরে খামার আছে, উঠানে লেবুগাছ আছে, গোটাকতক মল্লিকা যূঁইয়ের গাছ আছে, কিন্তু এবার তাতে ফুল নাই। সব ঘরের দাওয়ায় একটা একটা চরকা আছে; কিন্তু বাড়ীতে বড় লোক নাই। জীবানন্দ মেয়ে কোলে করিয়া সেই বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিল।

 বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়াই জীবানন্দ একটি ঘরের দাওয়ায় উঠিয়া একটা চরকা লইয়া ঘেনর ঘেনর আরম্ভ করিলেন। সে ছোট মেয়েটী কখন চরকার শব্দ শুনে নাই, বিশেষতঃ মা ছাড়া হইয়া অবধি কাঁদিতেছে, চরকার শব্দ শুনিয়া ভয় পাইয়া আরও উচ্চ সপ্তকে উঠিয়া কান্দিতে আরম্ভ করিল। তখন ঘরের ভিতর হইতে একটী সতের কি আঠার বৎসরের মেয়ে বাহির হইল। মেয়েটি বাহির হইয়াই দক্ষিণ গণ্ডে দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুলি সন্নিবিষ্ট করিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া দাঁড়াইল। “এ কি এ? দাদা চরকা কাটো কেন? মেয়ে কোথা পেলে? দাদা, তোমার মেয়ে হয়েছে না কি—আবার বিয়ে করেছ না কি?”

 জীবানন্দ মেয়েটি আনিয়া সে যুবতীর কোলে দিয়া তাহকে কীল মারিতে উঠিলেন, বলিলেন, “বাঁদরী, আমার আবার মেয়ে, আমাকে কি হেজিপেঁজি পেলে না কি? ঘরে দুধ আছে?”

 তখন সে যুবতী বলিল, “দুধ আছে বইকি, খাবে?”

 জীবানন্দ বলিল, “হাঁ খাব।”

 তখন সে যুবতী ব্যস্ত হইয়া দুধ জ্বাল দিতে গেল। জীবানন্দ ততক্ষণ চরকা ঘেনর ঘেনর করিতে লাগিলেন। মেয়েটী সেই যুবতীর কোলে গিয়া আর কাঁদে না। মেয়েটী কি ভাবিয়াছিল বলিতে পারি না—বোধ হয় এই যুবতীকে ফুল্লকুসুমতুল্য সুন্দরী দেখিয়া মা মনে করিয়াছিল। বোধ হয় উননের তাপের আঁচ মেয়েটীকে একবার লাগিয়াছিল, তাই সে একবার কাঁদিল। কান্না শুনিবামাত্র জীবানন্দ বলিলেন, “ও নিমি! ও পোড়ারমুখি! ও হনুমানি! তোর এখনও দুধ জ্বাল হলো না?” নিমি বলিল, “হয়েছে।” এই বলিয়া সে পাথর বাটীতে দুধ ঢালিয়া জীবানন্দের নিকট আনিয়া উপস্থিত করিল। জীবানন্দ কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “ইচ্ছে করে যে এই তপ্ত দুধের বাটী তোর গায়ে ঢালিয়া দিই—তুই কি মনে করেছিস আমি খাব না কি?”

 নিমি জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কে খাবে?”

 জীবা। ঐ মেয়েটা খাবে দেখছিস্‌নে, ঐ মেয়েটাকে দুধ খাওয়া।

 নিমি তখন আসনপিঁড়ি হইয়া বসিয়া মেয়েকে কোলে শোয়াইয়া ঝিনুক লইয়া তাহাকে দুধ খাওয়াইতে বসিল। সহসা তাহার চক্ষু হইতে ফোঁটাকতক জল পড়িল। তাহার একটী ছেলে হইয়া মরিয়া গিয়াছিল, তাহারই ঐ ঝিনুক ছিল। নিমি তখনই হাত দিয়া জল মুছিয়া হাসিতে হাসিতে জীবানন্দকে জিজ্ঞাসা করিল,—

 “হ্যাঁ দাদা, কার মেয়ে দাদা?”

 জীবানন্দ বলিলেন, “তোর কি রে পোড়ার মুখী?”

 নিমি বলিল, “আমায় মেয়েটী দেবে?”

 জীবানন্দ বলিল, “তুই মেয়ে নিয়ে কি করবি?”

 নিমি। আমি মেয়েটিকে দুধ খাওয়াব, কোলে করিব, মানুষ করিব—” বল্‌তে বল্‌তে ছাই পোড়ার চক্ষের জল আবার আসে, আবার নিমি হাত দিয়া মুছে, আবার হাসে।

 জীবানন্দ বলিল, “তুই নিয়ে কি কর্‌বি? তোর কত ছেলে মেয়ে হবে।”

 নিমি। তা হয় হবে, এখন এ মেয়েটী দাও, এর পর না হয় নিয়ে যেও।

 জীবা। তা নে, নিয়ে মরগে যা। আমি এসে মধ্যে মধ্যে দেখে যাব। উটি কায়েতের মেয়ে, আমি চল্‌লুম এখন—

 নিমি। সে কি দাদা, খাবে না! বেলা হয়েছে যে আমার মাথা খাও, দুটি খেয়ে যাও।

 জীবা। তোর মাথাও খাব, আবার দুটি খাব? দুই ত পেরে উঠবো না দিদি। মাথা রেখে দুটি ভাত দে।

 নিমি তখন মেয়ে কোলে করিয়া ভাত বাড়িতে ব্যতিব্যস্ত হইল।

 নিমি পিঁড়ি পাতিয়া জলছড়া দিয়া, জায়গা মুছিয়া মল্লিকাফুলের মত পরিষ্কার অন্ন, কাঁচা কলাইয়ের দাল, জঙ্গুলে ডুমুরের দাল‍না, পুকুরের রুইমাছের মুড়োর ঝোল, এবং দুগ্ধ আনিয়া জীবানন্দকে খাইতে দিল। খাইতে বসিয়া জীবানন্দ বলিলেন,

 “নিমাই দিদি, কে বলে মন্বন্তর? তোদের গাঁয়ে বুঝি মন্বন্তর আসে নি?”

 নিমি বলিল, “মন্বন্তর আসবে না কেন, বড় মন্বন্তর, তা আমরা দুটী মানুষ, ঘরে যা আছে, লোককে দিই থুই ও আপনারা খাই। আমাদের গাঁয়ে বৃষ্টি হইয়াছিল, মনে নাই?—তুমি যে সেই বলিয়া গেলে, বনে বৃষ্টি হয়। তা আমাদের গাঁয়ে কিছু ধান হয়েছিল—আর সবাই নগরে বেচে এল—আমরা বেচি নাই।”

 জীবানন্দ বলিল, “বোনাই কোথা?”

 নিমি ঘাড় হেঁট করিয়া চুপি চুপি বলিল, “সের দুই তিন চাল লইয়া কোথায় বেরিয়েছেন। কে নাকি চাল চেয়েছে।”

 এখন জীবানন্দর অদৃষ্টে এরূপ আহার অনেক কাল হয় নাই। জীবানন্দ আর বৃথা বাক্যব্যয়ে সময় নষ্ট না করিয়া গপ্‌গপ্ টপ্‌টপ্ সপ্‌সপ্ প্রভৃতি নানাবিধ শব্দ করিয়া অল্পকালমধ্যে অন্নব্যঞ্জনাদি শেষ করিলেন। এখন শ্রীমতী নিমাইমণি শুধু আপনার ও স্বামীর জন্যা রাঁধিয়াছিলেন, আপনার ভাতগুলি দাদাকে দিয়াছিলেন, পাথর শূন্য দেখিয়া অপ্রতিভ হইয়া স্বামীর অন্নব্যঞ্জনগুলি আনিয়া ঢালিয়া দিলেন। জীবানন্দ ভ্রূক্ষেপ না করিয়া সে সকলই উদরনামক বৃহৎ গর্ত্তে প্রেরণ করিলেন। তখন নিমাইমণি বলিল, “দাদা, আর খাবে কিছু?”

 জীবানন্দ বলিল, “আর কি আছে?”

 নিমাইমণি বলিল, “একটা পাকা কাঁটাল আছে।”

 নিমাই সে পাকা কাঁটাল আনিয়া দিল—বিশেষ কোন আপত্তি না করিয়া জীবানন্দ গোস্বামী কাঁটালটীকেও সেই ধ্বংসপুরে পাঠাইলেন। তখন নিমাই হাসিয়া বলিল,

 “দাদা আর কিছু নাই।”

 দাদা বলিলেন, “তবে যা। আর একদিন আসিয়া খাইব।”

 অগত্যা নিমাই জীবানন্দকে আঁচাইবার জল দিল। জল দিতে দিতে নিমাই বলিল, “দাদা, আমার একটা কথা রাখিবে?”

 জীবা। কি?

 নিমি। আমার মাথা খাও।

 জীবা। কি বল্‌ না পোড়ারমুখী।

 নিমি। কথা রাখ্‌বে?

 জীবা। কি আগে বল্‌ না।

 নিমি। আমার মাথা খাও পায়ে পড়ি।

 জীবা। তোর মাথাও খাই—তুই পায়েও পড়, কিন্তু কি বল?

 নিমাই তখন এক হাতে আর এক হাতের আঙুলগুলি টিপিয়া, ঘাড় হেঁট করিয়া, সেইগুলি নিরীক্ষণ করিয়া, একবার জীবানন্দের মুখপানে চাহিয়া একবার মাটীপানে চাহিয়া, শেষ মুখ ফুটিয়া বলিল, “একবার বউ্কে‌ ডাকবো?”

 জীবানন্দ আঁচাইবার গাড়ু তুলিয়া নিমির মাথায় মারিতে উদ্যত; বলিলেন, “আমার মেয়ে ফিরিয়ে দে, আর আমি একদিন তোর চাল দাল ফিরিয়া দিয়া যাইব। তুই বাঁদরী, তুই পোড়ারমুখী, তুই যা না বল্‌বার তাই আমাকে বলিস্‌।”

 নিমাই বলিল, “তা হউক, আমি বাঁদরী, আমি পোড়ারমুখী। একবার বৌকে ডাক্‌বো?”

 জীবা। “আমি চল্লুম, এই বলিয়া জীবানন্দ হন্‌হন্‌ করিয়া বাহির হইয়া যায়,—নিমাই গিয়া দ্বারে দাঁড়াইল, দ্বারের কবাট রুদ্ধ করিয়া, দ্বারে পিঠ দিয়া বলিল, “আগে আমায় মেরে ফেল, তবে তুমি যাও। বৌয়ের সঙ্গে না দেখা করে তুমি যেতে পার্‌বে না।”

 জীবানন্দ বলিল, “আমি কত লোক মারিয়া ফেলিয়াছি, তা তুই জানিস্‌?”

 এইবার নিমি রাগ করিল, বলিল, “বড় কীর্ত্তিই করেছ—স্ত্রী ত্যাগ কর্‌বে, লোক মার্‌বে, আমি তোমায় ভয় করবো, তুমিও যে বাপের সন্তান, আমিও সেই বাপের সন্তান—লোক মারা যদি বড়াইয়ের কথা হয়, আমায় মেরে বড়াই কর।”

 জীবানন্দ হাসিল, “ডেকে নিয়ে আয়—কোন্ পাপিষ্ঠাকে ডেকে নিয়ে আস্‌বি নিয়ে আয়, কিন্তু দেখ্‌ ফের যদি এমন কথা বল্‌বি, তোকে কিছু বলি না বলি সেই শালার ভাই শালাকে মাথা মুড়াইয়া দিয়া ঘোল ঢেলে উল্টা গাধায় চড়িয়ে দেশের বার্‌ করে দিব।”

 নিমি মনে মনে বলিল, “আমিও তা হলে বাঁচি।” এই বলিয়া হাসিতে হাসিতে নিমি বাহির হইয়া গেল, নিকটবর্ত্তী এক পর্ণকুটীরে গিয়া প্রবেশ করিল। কুটীরমধ্যে শতগ্রন্থিযুক্ত বসনপরিধানা রুক্ষ্মকেশা এক স্ত্রীলোক বসিয়া চরকা কাটিতেছিল। নিমাই গিয়া বলিল, “বৌ শিগ্‌গির, শিগ্‌গির!” বৌ বলিল, “শিগ্‌গির কি

লো! ঠাকুর জামাই তোকে মেরেছে নাকি, ঘায়ে তেল মাখিয়ে দিতে হবে?”

 নিমি। কাছাকাছি বটে, তেল আছে ঘরে?

 সে স্ত্রীলোক তৈলের ভাণ্ড বাহির করিয়া দিল। নিমাই ভাণ্ড হইতে তাড়াতাড়ি অঞ্জলি অঞ্জলি তৈল লইয়া সেই স্ত্রীলোকের মাথায় মাখাইয়া দিল। তাড়াতাড়ি একটা চলনসই খোঁপা বাঁধিয়া দিল। তার পর তাহাকে কীল মারিয়া বলিল, “তোর সেই ঢাকাই কোথা আছে বল।” সে স্ত্রীলোক কিছু বিস্মিতা হইয়া বলিল, “কি লো তুই কি খেপেছিস্‌ নাকি?”

 নিমাই দুম করিয়া তাহার পিঠে এক কীল মারিল, বলিল, “শাড়ী বের কর।”

 রঙ্গ দেখিবার জন্য সে স্ত্রীলোক শাড়ীখানি বাহির করিল। রঙ্গ দেখিবার জন্য, কেন না, এত দুঃখেও রঙ্গ দেখিবার যে বৃত্তি তাহা তাহার হৃদয়ে লুপ্ত হয় নাই। নবীন যৌবন; ফুল্লকমলতুল্য তাহার নববয়সের সৌন্দর্য্য; তৈল নাই,—বেশ নাই—আহার নাই—তবু সেই প্রদীপ্ত, অননুমেয় সৌন্দর্য্য সেই শতগ্রন্থিযুক্ত বসনমধ্যেও প্রস্ফুটিত। বর্ণে ছায়ালোকের চাঞ্চল্য, নয়নে কটাক্ষ, অধরে হাসি, হৃদয়ে ধৈর্য্য। আহার নাই—তবু শরীর লাবণ্যময়, বেশভূষা নাই, তবু সে সৌন্দর্য্য সম্পূর্ণ অভিব্যক্ত। যেমন মেঘমধ্যে বিদ্যুৎ, যেমন মনোমধ্যে প্রতিভা, যেমন জগতের শব্দমধ্যে সঙ্গীত, যেমন মরণের ভিতর সুখ, তেমনি সে রূপরাশিতে অনির্ব্বচনীয় কি ছিল! অনির্ব্বচনীয় মাধুর্য্য, অনির্ব্বচনীয় উন্নতভাব, অনির্ব্বচনীয় প্রেম, অনির্ব্বচনীয় ভক্তি। সে হাসিতে হাসিতে (কেহ সে হাসি দেখিল না), হাসিতে হাসিতে সেই ঢাকাই শাড়ী বাহির করিয়া দিল। বলিল, “কি লো নিমি, কি হইবে?” নিমাই বলিল, “তুই পরবি।” সে বলিল, “আমি পরিলে কি হইবে?” তখন নিমাই তাহার কমনীয় কণ্ঠে আপনার কমনীয় বাহু বেষ্টন করিয়া বলিল, “দাদা এসেছে, তোকে যেতে বলেছে।” সে বলিল, “আমায় যেতে বলেছেন? ত ঢাকাই শাড়ী কেন? চল না এমনি যাই।” নিমাই তার গালে এক চড় মারিল—সে নিমাইয়ের কাঁধে হাত দিয়া তাহাকে কুটীরের বাহির করিল। বলিল, “চল, এই ন্যাক‍ড়া পরিয়া তাঁহাকে দেখিয়া আসি।” কিছুতেই কাপড় বদলাইল না, অগত্যা নিমাই রাজি হইল। নিমাই তাহাকে সঙ্গে লইয়া আপনার বাড়ীর দ্বার পর্য্যন্ত গেল, গিয়া তাহাকে ভিতরে প্রবেশ করাইয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া আপনি দ্বারে দাঁড়াইয়া রহিল।