গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড)/কর্মফল

উইকিসংকলন থেকে

গল্পগুচ্ছ

তৃতীয় খণ্ড

কর্মফল

প্রথম পরিচ্ছেদ

আজ সতীশের মাসি সুকুমারী এবং মেসোমশায় শশধরবাবু আসিয়াছেন— সতীশের মা বিধুমুখী ব্যস্তসমস্তভাবে তাঁহাদের অভ্যর্থনায় নিযুক্ত। “এসো দিদি, বোসো। আজ কোন্‌ পুণ্যে রায়মশায়ের দেখা পাওয়া গেল! দিদি না আসলে তোমার আর দেখা পাবার জো নেই।”

 শশধর। এতেই বুঝবে তোমার দিদির শাসন কিরকম কড়া। দিনরাত্রি চোখে চোখে রাখেন।

 সুকুমারী। তাই বটে, এমন রত্ন ঘরে রেখেও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমনো যায় না।

 বিধুমুখী। নাকডাকার শব্দে!

 সুকুমারী। সতীশ, ছি ছি, তুই এ কী কাপড় পরেছিস। তুই কি এইরকম ধুতি পরে ইস্কুলে যাস নাকি। বিধু, ওকে যে ফ্রকটা কিনে দিয়েছিলেম সে কী হল।

 বিধুমুখী। সে ও কোন্‌ কালে ছিঁড়ে ফেলেছে।

 সুকুমারী। তা তো ছিঁড়বেই। ছেলেমানুষ গায়ে এক কাপড় কতদিন টেঁকে। তা, তাই বলে কি আর নূতন ফ্রক তৈরি করাতে নেই। তোদের ঘরে সকলই অনাসৃষ্টি।

 বিধুমুখী। জানোই তো দিদি, তিনি ছেলের গায়ে সভ্য কাপড় দেখলেই আগুন হয়ে ওঠেন। আমি যদি না থাকতেম তো তিনি বোধ হয় ছেলেকে দোলাই গায়ে দিয়ে কোমরে ঘুনসি পরিয়ে ইস্কুলে পাঠাতেন— মাগো! এমন সৃষ্টিছাড়া পছন্দও কারো দেখি নি।

 সুকুমারী। মিছে না। এক বই ছেলে নয়— একে একটু সাজাতে গোজাতেও ইচ্ছা করে না! এমন বাপও তো দেখি নি। সতীশ, পরশু রবিবার আছে, তুই আমাদের বাড়ি যাস, আমি তোর জন্যে এক সুট কাপড় র‍্যাম্‌জের ওখান হতে আনিয়ে রাখব। আহা, ছেলেমানুষের কি শখ হয় না।

 সতীশ। এক—সুটে আমার কী হবে মাসিমা। ভাদুড়ি সাহেবের ছেলে আমার সঙ্গে একসঙ্গে পড়ে, সে আমাকে তাদের বাড়িতে পিংপং খেলায় নিমন্ত্রণ করেছে— আমার তো সেরকম বাইরে যাবার মখমলের কাপড় নেই।

 শশধর। তেমন জায়গায় নিমন্ত্রণে না যাওয়াই ভালো, সতীশ।

 সুকুমারী। আচ্ছা আচ্ছা, তোমার আর বক্তৃতা দিতে হবে না। ওর যখন তোমার মতন বয়স হবে তখন—

 শশধর। তখন ওকে বক্তৃতা দেবার অন্য লোক হবে, বৃদ্ধ মেসোর পরামর্শ শোনবার অবসর হবে না।

 সুকুমারী। আচ্ছা মশায়, বক্তৃতা করবার অন্য লোক যদি তোমাদের ভাগ্যে না জুটত তবে তোমাদের কী দশা হত বলো দেখি।

 শশধর। সে কথা বলে লাভ কী। সে অবস্থা কল্পনা করাই ভালো।

 সতীশ। (নেপথ্যের দিকে চাহিয়া) না না, এখানে আনতে হবে না, আমি যাচ্ছি।

প্রস্থান

 সুকুমারী। সতীশ ব্যস্ত হয়ে পালালো কেন, বিধু।

 বিধুমুখী। থালায় করে তার জলখাবার আনছিল কিনা, ছেলের তাই তোমাদের সামনে লজ্জা।

 সুকুমারী। আহা, বেচারার লজ্জা হতে পারে। ও সতীশ, শোন্, শোন্। তোর মেসোমশায় তোকে পেলেটির বাড়ি থেকে আইসক্রীম খাইয়ে আনবেন, তুই ওঁর সঙ্গে বা। ওগো, যাও-না, ছেলেমানুষকে একটু—

 সতীশ। মাসিমা, সেখানে কী কাপড় পরে যাব।

 বিধুমুখী। কেন, তোর তো চাপকান আছে।

 সতীশ। সে বিশ্রী।

 সকুমারী। আর যাই হোক বিধু, তোর ছেলে ভাগ্যে পৈতৃক পছন্দটা পায় নি তাই রক্ষা। বাস্তবিক, চাপকান দেখলেই খানসামা কিম্বা যাত্রার দলের ছেলে মনে পড়ে। এমন অসভ্য কাপড় আর নেই।

 শশধর। এ কথাগুলো—

 সুকুমারী। চুপিচুপি বলতে হবে? কেন, ভয় করতে হবে কাকে। মন্মথ নিজের পছন্দমতো ছেলেকে সাজ করাবেন আর আমরা কথা কইতেও পাব না?

 শশধর। সর্বনাশ। কথা বন্ধ করতে আমি বলি নে। কিন্তু সতীশের সামনে এ-সমস্ত আলোচনা—

 সকুমারী। আচ্ছা আচ্ছা, বেশ। তুমি ওকে পেলেটির ওখানে নিয়ে যাও।

 সতীশ। না মাসিমা, আমি সেখানে চাপকান পরে যেতে পারব না।

 সুকুমারী। এই-যে মন্মথবাবু, আসছেন। এখনি সতীশকে নিয়ে বকাবকি করে ওকে অস্থির করে তুলবেন। ছেলেমানুষ, বাপের বকুনির চোটে ওর একদণ্ড শান্তি নেই। আয় সতীশ, তুই আমার সঙ্গে আয়—আমরা পালাই।

সকুমারীর প্রস্থান। মন্মথর প্রবেশ

 বিধু। সতীশ ঘড়ি ঘড়ি করে কয়দিন আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। দিদি তাকে একটা রুপোর ঘড়ি দিয়েছেন—আমি আগে থাকতে বলে রাখলেম, তুমি আবার শুনলে রাগ করবে।

বিধুমুখীর প্রধান

 মন্মথ। আগে থাকতে বলে রাখলেও রাগ করব। শশধর, সে ঘড়িটি তোমাকে নিয়ে যেতে হবে।

 শশধর। তুমি তো আচ্ছা লোক। নিয়ে তো গেলেম, শেষকালে বাড়ি গিয়ে জবাবদিহি করবে কে।

 মন্মথ। না শশধর, ঠাট্টা নয়, আমি এ-সব ভালোবাসি নে।

 শশধর। ভালোবাস না, কিন্তু সহ্যও করতে হয়—সংসারে এ কেবল তোমার একলারই পক্ষে বিধান নয়।

 মন্মথ। আমার নিজের সম্বন্ধে হলে আমি নিঃশব্দে সহ্য করতেম। কিন্তু ছেলেকে আমি মাটি করতে পারি না। যে ছেলে চাবা-মাত্রই পায়, চাবার পবেই যার অভাবমোচন হতে থাকে, সে নিতান্ত দুর্ভাগা। ইচ্ছা দমন করতে না শিখে কেউ কোনো কালে সুখী হতে পারে না। বঞ্চিত হয়ে ধৈর্যরক্ষা করবার যে-বিদ্যা—আমি তাই ছেলেকে দিতে চাই, ঘড়ি ঘড়ির-চেন জোগাতে চাই নে।

 শশধর। সে তো ভালো কথা, কিন্তু তোমার ইচ্ছামাত্রেই তো সংসারের সমস্ত বাধা তখনি ধুলিসাৎ হবে না। সকলেরই যদি তোমার মতো সদ্‌বুদ্ধি থাকত তা হলে তো কথাই ছিল না; তা যখন নেই তখন সাধুসংকল্পকেও গায়ের জোরে চালানো যায় না, ধৈর্য চাই। স্ত্রীলোকের ইচ্ছার একেবারে উলটামুখে চলবার চেষ্টা করলে অনেক বিপদে পড়বে—তার চেয়ে পাশ কাটিয়ে একটু ঘুরে গেলে সুবিধামতো ফল পাওয়া যায়। বাতাস যখন উলটা বয় জাহাজের পাল তখন আড় করে রাখতে হয়, নইলে চলা অসম্ভব।

 মন্মথ। তাই বুঝি তুমি গৃহিণীর সকল কথাতেই সায় দিয়ে যাও। ভীরু!

 শশধর। তোমার মতো অসম সাহস আমার নেই। যাঁর ঘরকন্নার অধীনে চবিশ ঘণ্টা বাস করতে হয় তাঁকে ভয় না করব তো কাকে করব। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে বীরত্ব করে লাভ কী। আঘাত করলেও কষ্ট, আঘাত পেলেও কষ্ট। তার চেয়ে তর্কের বেলায় গহিণীর মতকে সম্পূর্ণ অকাট্য বলে স্বীকার করে কাজের বেলায় নিজের মত চালানোই সৎপরামর্শ—গোঁয়ার্‌তুমি করতে গেলেই মুশকিল বাধে।

 মন্মথ। জীবন যদি সুদীর্ঘ হত তবে ধীরে-সুস্থে তোমার মতে চলা যেত, পরমায়ু যে অল্প।

 শশধর। সেইজন্যই তো ভাই, বিবেচনা করে চলতে হয়। সামনে একটা পাথর পড়লে যে লোক ঘরে না গিয়ে সেটা ডিঙিয়ে পথ সংক্ষেপ করতে চায়, বিলম্ব তারই অদৃষ্টে আছে। কিন্তু তোমাকে এ-সকল বলা বৃথা—প্রতিদিনই তো ঠেকছ তবু যখন শিক্ষা পাচ্ছ না, তখন আমার উপদেশে ফল নেই। তুমি এমনি ভাবে চলতে চাও যেন তোমার স্ত্রী ব’লে একটা শক্তির অস্তিত্ব নেই—অথচ তিনি যে আছেন সম্বন্ধে তোমার লেশমাত্র সন্দেহ থাকবার কোনো কারণ দেখি নে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দাম্পত্য কলহে চৈব বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া—শাস্ত্রে এইরূপ লেখে। কিন্তু দম্পতি বিশেষে ইহার ব্যতিক্রম ঘটে, অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাহা অস্বীকার করেন না।

 মন্মথবাবুর সহিত তাঁহার স্ত্রীর মধ্যে মধ্যে যে বাদপ্রতিবাদ ঘটিয়া থাকে তাহা নিশ্চয়ই কলহ, তবু তাহার আরম্ভ বহু নহে, তাহার ক্রিয়াও লঘু নহে—ঠিক অজাযুদ্ধের সঙ্গে তাহার তুলনা করা চলে না। কয়েকটি দৃষ্টান্তদ্বারা এ কথার প্রমাণ হইবে।

 মন্মথবাবু কহিলেন, “তোমার ছেলেটিকে যে বিলিতি পোশাক পরাতে আরম্ভ করেছ, সে আমার পছন্দ নয়।”

 বিধু কহিলেন, “পছন্দ বুঝি একা তোমারই আছে। আজকাল তো সকলেই ছেলেদের ইংরেজি কাপড় ধরিয়েছে।”

 মন্মথ হাসিয়া কহিলেন, “সকলের মতেই যদি চলবে তবে সকলকে ছেড়ে একমাত্র আমাকেই বিবাহ করলে কেন।”

বিধু। তুমি যদি কেবল নিজের মতেই চলবে তবে একা না থেকে আমাকেই বা তোমার বিবাহ করবার কী দরকার ছিল।

 মন্মথ। নিজের মত চালাবার জন্যও যে অন্য লোকের দরকার হয়।

 বিধু। নিজের বোঝা বহাবার জন্য ধোবার দরকার হয় গাধাকে, কিন্তু আমি তো আর—

 মন্মথ। (জিব কাটিয়া) আরে রাম রাম, তুমি আমার সংসার-মরুভূমির আরব ঘোড়া। কিন্তু সে প্রাণীবৃত্তান্তের তর্ক এখন থাক্। তোমার ছেলেটিকে সাহেব করে তুলো না।

 বিধু। কেন করব না। তাকে কি চাষা করব।

 এই বলিয়া বিধু ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

 বিধুর বিধবা জা পাশের ঘরে বসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া মনে করিলেন, স্বামীস্ত্রীতে বিরলে প্রেমালাপ হইয়া গেল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

 মন্মথ। ও কী ও, তোমার ছেলেটিকে কী মাখিয়েছ।

 বিধু। মূর্ছা যেয়ো না, ভয়ানক কিছু নয়, একটুখানি এসেন্স্ মাত্র। তাও বিলাতি নয়—তোমাদের সাধের দিশি।

 মন্মথ। আমি তোমাকে বারবার বলেছি, ছেলেদের তুমি এ-সমস্ত শৌখিন জিনিস অভ্যাস করাতে পারবে না।

 বিধু। আচ্ছা, যদি তোমার আরাম বোধ হয় তো কাল হতে কেরোসিন এবং ক্যাস্টর অয়েল মাখাব।

 মন্মথ। সেও বাজে খরচ হবে। যেটা না হলেও চলে সেটা না অভ্যাস করাই ভালো; কেরোসিন, ক্যাস্টর অয়েল গায়ে মাথায় মাখা আমার মতে অনাবশ্যক।

 বিধু। তোমার মতে আবশ্যক জিনিস কটা আছে তা তো জানি না, গোড়াতেই আমাকে বোধ হয় বাদ দিয়ে বসতে হয়।

 মন্মথ। তোমাকে বাদ দিলে যে বাদপ্রতিবাদ একেবারেই বন্ধ হবে। এতকালের দৈনিক অভ্যাস হঠাৎ ছাড়লে এবয়সে হয়তো সহ্য হবে না। যাই হোক, একথা আমি তোমাকে আগে হতে বলে রাখছি, ছেলেটিকে তুমি সাহেব কর বা নবাব কর বা সাহেবি-নবাবির খিচুড়ি পাকাও, তার খরচ আমি জোগাব না। আমার মৃত্যুর পরে সে যা পাবে তাতে তার শখের খরচ কুলোবে না।

 বিধু। সে আমি জানি। তোমার টাকার উপরে ভরসা রাখলে ছেলেকে কোপ্‌নি পরানো অভ্যাস করতেম।

 বিধুর এই অবজ্ঞাবাক্যে মর্মাহত হইয়াও মন্মথ ক্ষণকালের মধ্যে সামলাইয়া লইলেন; কহিলেন, “আমিও তা জানি। তোমার ভগিনীপতি শশধরের পরেই তোমার ভরসা। তার সন্তান নেই বলে ঠিক করে বসে আছ, তোমার ছেলেকেই সে উইলে সমস্ত লিখে-পড়ে দিয়ে যাবে। সেইজন্যই যখন-তখন ছেলেটাকে ফিরিঙ্গি সাজিয়ে একগা গন্ধ মাখিয়ে তার মেসোর আদর কাড়বার জন্য পাঠিয়ে দাও। আমি দারিদ্র্যের লজ্জা অনায়াসেই সহ্য করতে পারি, কিন্তু ধনী কুটুম্বের সোহাগযাচনার লজ্জা আমার সহ্য হয় না।”

 এ-কথা মন্মথর মনে অনেকদিন উদয় হইয়াছে, কিন্তু কথাটা কঠোর হইবে বলিয়া এ-পর্যন্ত কখনো বলেন নাই। বিধু মনে করিতেন, স্বামী তাঁহার গূঢ় অভিপ্রায় ঠিক বুঝিতে পারেন নাই, কারণ স্বামীসম্প্রদায় স্ত্রীর মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে অপরিসীম মূর্খ। কিন্তু মন্মথ যে বসিয়া বসিয়া তাঁহার চাল ধরিতে পারিয়াছেন, হঠাৎ জানিতে পারিয়া বিধুর পক্ষে মর্মান্তিক হইয়া উঠিল।

 মুখ লাল করিয়া বিধু কহিলেন, “ছেলেকে মাসির কাছে পাঠালেও গায়ে সয় না, এতবড় মানী লোকের ঘরে আছি সে তো পর্বে বুঝতে পারি নি।”

 এমন সময় বিধবা জা প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “মেজবউ, তোদের ধন্য। আজ সতেরো বৎসর হয়ে গেল তবু তোদের কথা ফুরালো না! রাত্রে কুলায় না, শেষকালে দিনেও দুইজনে মিলে ফিস্‌ফিস্! তোদের জিবের আগায় বিধাতা এত মধু দিনরাত্রি জোগান কোথা হতে আমি তাই ভাবি। রাগ কোরো না ঠাকুরপো, তোমাদের মধুরালাপে ব্যাঘাত করব না, একবার কেবল দু মিনিটের জন্য মেজবউয়ের কাছ হতে শেলাইয়ের প্যাটার্নটা দেখিয়ে নিতে এসেছি।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

 সতীশ। জেঠাইমা!

 জেঠাইমা। কী বাপ।

 সতীশ। আজ ভাদুড়িসাহেবের ছেলেকে মা চা খাওয়াবেন, তুমি যেন সেখানে হঠাৎ গিয়ে পোড়ো না।

 জেঠাইমা। আমার যাবার দরকার কী, সতীশ।

 সতীশ। যদি যাও তো তোমার এ কাপড়ে চলবে না, তোমাকে—

 জেঠাইমা। সতীশ, তোর কোন ভয় নেই, আমি এই ঘরেই থাকব, যতক্ষণ তোর বন্ধুর চা খাওয়া না হয়, আমি বার হব না।

 সতীশ। জেঠাইমা, আমি মনে করছি, তোমার এই ঘরেই তাকে চা খাওয়াবার বন্দোবস্ত করব। এ বাড়িতে আমাদের যে ঠাসাঠাসি লোক——চা খাবার, ডিনার খাবার মতো ঘর একটাও খালি পাবার জো নেই। মার শোবার ঘরে সিন্দক-ফিন্দুক কত কী রয়েছে, সেখানে কাকেও নিয়ে যেতে লজ্জা করে।

 জেঠাইমা। আমার এখানেও তো জিনিসপত্র—

 সতীশ। ওগুলো আজকের মতো বার করে দিতে হবে। বিশেষত তোমার এই বঁটি-চুপড়ি-বারকোশগুলো কোথাও না লুকিয়ে রাখলে চলবে না।

 জেঠাইমা। কেন বাবা, ওগুলোতে এত লজ্জা কিসের। তাদের বাড়িতে কি কুটনো কুটবার নিয়ম নেই।

 সতীশ। তা জানি নে জেঠাইমা, কিন্তু চা খাবার ঘরে ওগুলো রাখা দস্তুর নয়। এ দেখলে নরেন ভাদুড়ি নিশ্চয় হাসবে, বাড়ি গিয়ে তার বোনদের কাছে গল্প করবে।

 জেঠাইমা। শোনো একবার, ছেলের কথা শোনো। বঁটি-চুপড়ি তো চিরকাল ঘরেই থাকে। তা নিয়ে গল্প করতে তো শুনি নি।

 সতীশ। তোমাকে আর-এক কাজ করতে হবে,— জেঠাইমা—আমাদের নন্দকে তুমি যেমন করে পার এখানে ঠেকিয়ে রেখো। সে আমার কথা শুনবে না, খালি গায়ে ফস করে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবে।

 জেঠাইমা। তাকে যেন ঠেকালেম, কিন্তু তোমার বাবা যখন খালি গায়ে—

 সতীশ। সে আমি আগেই মাসিমাকে গিয়ে ধরেছিলেম, তিনি বাবাকে আজ পিঠে খাবার নিমন্ত্রণ করেছেন, বাবা এ-সমস্ত কিছুই জানেন না।

 জেঠাইমা। বাবা সতীশ, যা মন হয় করিস, কিন্তু আমার ঘরটাতে তোদের ঐ খানাটানাগুলো—

 সতীশ। সে ভালো করে সাফ করিয়ে দেব এখন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

 সতীশ। মা, এমন করে তো চলে না।

 বিধু। কেন, কী হয়েছে।

 সতীশ। চাঁদনির কোট ট্রাউজার পরে আমার বার হতে লজ্জা করে। সেদিন ভাদুড়িসাহেবের বাড়ি ইভনিং পার্টি ছিল, কয়েকজন বাবু ছাড়া আর সকলেই ড্রেস সুট পরে গিয়েছিল, আমি সেখানে এই কাপড়ে গিয়ে ভারি অপ্রস্তুতে পড়েছিলাম। বাবা কাপড়ের জন্য যে সামান্য টাকা দিতে চান তাতে ভদ্রতা রক্ষা হয় না।

 বিধ। জান তো সতীশ, তিনি যা ধরেন তা কিছুতেই ছাড়েন না। কত টাকা হলে তোমার মনের মতো পোশাক হয়, শুনি।

 সতীশ। একটা মর্নিং সুট আর একটা লাউঞ্জ সুটে এক-শ টাকার কাছাকাছি লাগবে। একটা চলনসই ইভনিং ড্রেস দেড়শ টাকার কমে কিছুতেই হবে না।

 বিধু। বল কী, সতীশ। এ তো তিন-শ টাকার ধাক্কা, এত টাকা—

 সতীশ। মা, ঐ তোমাদের দোষ। এক ফকিরি করতে চাও সে ভালো, আর যদি ভদ্রসমাজে মিশতে হয় তবে অমন টানাটানি করে চলে না। ভদ্রতা রাখতে গেলে তো খরচ করতে হবে, তার তো কোনো উপায় নেই। সুন্দরবনে পাঠিয়ে দাওনা কেন, সেখানে ড্রেস কোটের দরকার হবে না।

 বিধু। তা তো জানি, কিন্তু—আচ্ছা, তোমার মেসো তো তোমাকে জন্মদিনের উপহার দিয়ে থাকেন, এবারকার জন্য একটা নিমন্ত্রণের পোশাক তাঁর কাছ হতে জোগাড় করে নাও-না। কথায় কথায় তোমার মাসির কাছে একট, আভাস দিলেই হয়।

 সতীশ। সে তো অনায়াসেই পারি, কিন্তু বাবা যদি টের পান আমি মেসোর কাছ হতে কাপড় আদায় করেছি, তা হলে রক্ষা থাকবে না।

 বিধু। আচ্ছা, সে আমি সামলাতে পারব।

সতীশের প্রস্থান

 ভাদুড়িসাহেবের মেয়ের সঙ্গে যদি সতীশের কোনো মতে বিবাহের জোগাড় হয় তা হলেও আমি সতীশের জন্য অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। ভাদুড়িসাহেব ব্যারিস্টার মানুষ, বেশ দু-দশ টাকা রোজগার করে। ছেলেবেলা হতেই সতীশ তো ওদের বাড়ি আনাগোনা করে, মেয়েটি তো আর পাষাণ নয়, নিশ্চয় আমার সতীশকে পছন্দ করবে। সতীশের বাপ তাে এ-সব কথা একবার চিন্তাও করেন না, বলতে গেলে আগুন হয়ে ওঠেন, ছেলের ভবিষ্যতের কথা আমাকেই সমস্ত ভাবতে হয়।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

মিস্টার ভাদুড়ির বাড়িতে টেনিসক্ষেত্র

 নলিনী। ও কী সতীশ, পালাও কোথায়?

 সতীশ। তােমাদের এখানে টেনিস পার্টি জানতেম না, আমি টেনিস সুট পরে আসি নি।

 নলিনী। সকল গােরুর তাে এক রঙের চামড়া হয় না, তােমার নাহয় ওরিজিন্যাল বলেই নাম রটবে। আচ্ছা, আমি তােমার সুবিধা করে দিচ্ছি। মিস্টার নন্দী, আপনার কাছে আমার একটা অনুরােধ আছে।

 নন্দী। অনুরোেধ কেন, হকুম বলুন না—আমি আপনারই সেবার্থে।

 নলিনী। যদি একবারে অসাধ্য বােধ না করেন তাে আজকের মতাে আপনারা সতীশকে মাপ করবেন—ইনি আজ টেনিস সুট পরে আসেন নি। এতবড়াে শোচনীয় দুর্ঘটনা।

 নন্দী। আপনি ওকালতি করলে খুন জাল ঘর-জ্বালানােও মাপ করতে পারি। টেনিস সুট না পরে এলে যদি আপনার এত দয়া হয় তবে আমার এই টেনিস সুটটা মিস্টার সতীশকে দান করে তাঁর এই—এটাকে কী বলি! তােমার এটা কী সুট, সতীশ—খিচুড়ি সুটই বলা যাক—তা আমি সতীশের এই খিচুড়ি সুটটা পরে রােজ এখানে আসব। আমার দিকে যদি স্বর্গের সমস্ত সুর্য চন্দ্র তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তবু লজ্জা করব না। সতীশ, এ কাপড়টা দান করতে যদি তােমার আপত্তি থাকে তবে তােমার দরজির ঠিকানাটা আমাকে দিয়ো। ফ্যাশানেবল ছাঁটের চেয়ে মিস ভাদুড়ির দয়া অনেক মুল্যবান্।

 নলিনী। শােনাে শােনাে সতীশ, শুনে রাখাে। কেবল কাপড়ের ছাঁট নয়, মিষ্ট কথার ছাঁদও তুমি মিস্টার নন্দীর কাছে শিখতে পার। এমন আদর্শ আর পাবে না। বিলাতে ইনি ডিউক ডাচেস ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথাও কন নি। মিস্টার নন্দী, আপনাদের সময় বিলাতে বাঙালি ছাত্র কে কে ছিল।

 নন্দী। আমি বাঙালিদের সঙ্গে সেখানে মিশি নি।

 নলিনী। শুনছ, সতীশ? রীতিমতাে সভ্য হতে গেলে কত সাবধানে থাকতে হয়। তুমি বােধ হয় চেষ্টা করলে পারবে। টেনিস সুট সম্বন্ধে তােমার যেরকম সূক্ষ্ম ধর্মজ্ঞান তাতে আশা হয়।

অন্যত্র গমন

 সতীশ। (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) নেলিকে আজ পর্যন্ত বুঝতেই পারলেম না। আমাকে দেখে ও বােধ হয় মনে মনে হাসে। আমারও মুশকিল হয়েছে, আমি কিছুতে এখানে এসে সুস্থমনে থাকতে পারি নে—কেবলই মনে হয়, আমার টাইটা বুঝি কলারের উপরে উঠে গেছে, আমার ট্রাউজারে হাঁটুর কাছটায় হয়তাে কুঁচকে আছে। নন্দীর মতাে কবে আমিও বেশ ঐরকম অনায়াসে স্ফূর্তির সঙ্গে—

 নলিনী। (পুনরায় আসিয়া) কী সতীশ, এখনো যে তোমার মনের খেদ মিটল না। টেনিস কোর্তার শোকে তোমার হদয়টা যে বিদীর্ণ হয়ে গেল। হায়, কোর্তাহারা হদয়ের সান্ত্বনা জগতে কোথায় আছে—দরজির বাড়ি ছাড়া।

 সতীশ। আমার হদয়টার খবর যদি রাখতে তবে এমন কথা আর বলতে না, নেলি।

 নলিনী। (করতালি দিয়া) বাহবা। মিস্টার নন্দীর দৃষ্টান্তে মিষ্ট কথার আমদানি এখনই শুরু হয়েছে। প্রশ্রয় পেলে অত্যন্ত উন্নতি হবে ভরসা হচ্ছে। এসো, একটু কেক খেয়ে যাবে, মিষ্ট কথার পুরস্কার মিষ্টান্ন।

 সতীশ। না, আজ আর খাব না, আমার শরীরটা—

 নলিনী। সতীশ, আমার কথা শোনো—টেনিস কোর্তার খেদে শরীর নষ্ট কোরো না, খাওয়াদাওয়া একেবারে ছাড়া ভালো নয়। কোর্তা জিনিসটা জগতের মধ্যে সেরা জিনিস সন্দেহ নেই, কিন্তু এই তুচ্ছ শরীরটা না হলে সেটা ঝুলিয়ে বেড়াবার সুবিধা হয় না।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

 শশধর। দেখো মন্মথ, সতীশের উপরে তুমি বড়ো কড়া ব্যবহার আরম্ভ করেছ; এখন বয়েস হয়েছে, এখন ওর প্রতি অতটা শাসন ভালো নয়।

 বিধ। বলো তো, রায়মশায়। আমি তো ওঁকে কিছুতেই বুঝিয়ে পারলেম না।

 মন্মথ। দুটো অপবাদ এক মুহূর্তেই! একজন বললেন নির্দয়, আর-একজন বললেন নির্বোধ। যাঁর কাছে হতবুদ্ধি হয়ে আছি তিনি যা বলেন সহ্য করতে রাজি আছি—তাঁর ভগ্নী যা বলবেন তার উপরেও কথা কব না, কিন্তু তাই ব’লে তাঁর ভগ্নীপতি পর্যন্ত সহিষ্ণুতা চলবে না। আমার ব্যবহারটা কী রকম কড়া শুনি।

 শশধর। বেচারা সতীশের একট, কাপড়ের শখ আছে, ও পাঁচ জায়গায় মিশতে আরম্ভ করেছে, ওকে তুমি চাঁদনির—

 মন্মথ। আমি তো চাঁদনির কাপড় পরতে বলি নে। ফিরিঙ্গি পোশাক আমার দু চক্ষের বিষ। ধুতি-চাদর চাপকান-চোগা পরুক, কখনো লজ্জা পেতে হবে না।

 শশধর। দেখো মন্মথ, সতীশ যদি এ-বয়সে শখ মিটিয়ে না নিতে পারে তবে বুড়োবয়সে খামকা কী করে বসবে, সে আরও বদ দেখতে হবে। আর ভেবে দেখো, যেটাকে আমরা শিশুকাল হতেই সভ্যতা বলে শিখছি তার আক্রমণ ঠেকাবে কী করে।

 মন্মথ। যিনি সভ্য হবেন তিনি সভ্যতার মালমসলা নিজের খরচেই জোগাবেন। যে-দিক হতে তোমার সভ্যতা আসছে টাকাটা সেদিক হতে আসছে না, বরং এখান হতে সেই দিকেই যাচ্ছে।

 বিধু। রায়মশায়, পেরে উঠবেন না—দেশের কথা উঠে পড়লে ওঁকে থামানো যায় না।

 শশধর। ভাই মন্মথ, ও-সব কথা আমিও বুঝি। কিন্তু, ছেলেদের আবদারও তো এড়াতে পারি নে। সতীশ ভাদুড়িসাহেবের সঙ্গে যখন মেশামেশি করছে তখন উপযুক্ত কাপড় না থাকলে ও-বেচারার বড়ো মুশকিল। আমি র‍্যাঙ্কিনের বাড়িতে ওর জন্য—

ভৃত্যের প্রবেশ

 ভৃত্য। সাহেব-বাড়ি হতে এই কাপড় এয়েছে।

 মন্মথ। নিয়ে যা কাপড়, নিয়ে যা। এখনি নিয়ে যা।

বিধুর প্রতি

 দেখো, সতীশকে যদি আমি এ কাপড় পরতে দেখি তবে তাকে বাড়িতে থাকতে দেব না, মেসে পাঠিয়ে দেব, সেখানে সে আপন ইচ্ছামতো চলতে পারবে।

দ্রুত প্রস্থান

 শশধর। অবাক কাণ্ড!

 বিধু। (সরোদনে) রায়মশায়, তোমাকে কী বলব, আমার বেঁচে সুখ নেই। নিজের ছেলের উপর বাপের এমন ব্যবহার কেউ কোথাও দেখেছে?

 শশধর। আমার প্রতি ব্যবহারটাও তো ঠিক ভালো হল না। বোধ হয় মন্মথর হজমের গোল হয়েছে। আমার পরামর্শ শোনো, তুমি ওকে রোজ সেই একই ডালভাত খাইয়ো না। ও যতই বলুক-না কেন, মাঝে মাঝে মসলাওয়ালা রান্না না হলে মুখে রোচে না, হজমও হয় না। কিছুদিন ওকে ভালো করে খাওয়াও দেখি, তার পরে তুমি যা বলবে ও তাই শুনবে। এ-সম্বন্ধে তোমার দিদি তোমার চেয়ে ভালো বোঝেন।

শশধরের প্রস্থান। বিধুমুখীর কুন্দন

 বিধবা জা। (ঘরে প্রবেশ করিয়া, আত্মগত) কখনো কান্না, কখনো হাসি—কতরকম যে সোহাগ তার ঠিক নেই—বেশ আছে।

দীর্ঘনিশ্বাস

 ও মেজবউ, গোসাঘরে বসেছিস! ঠাকুরপোকে ডেকে দিই, মানভঞ্জনের পালা হয়ে যাক।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

 নলিনী। সতীশ, আমি তোমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছি বলি, রাগ কোরো না।

 সতীশ। তুমি ডেকেছ ব’লে রাগ করব আমার মেজাজ কি এতই বদ।

 নলিনী। না, ও-সব কথা থাক্। সকল সময়েই নন্দীসাহেবের চেলাগিরি কোরো না। বলো দেখি আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে অমন দামি জিনিস কেন দিলে।

 সতীশ। যাকে দিয়েছি তার তুলনায় জিনিসটার দাম এমনই কি বেশি।

 নলিনী। আবার ফের নন্দীর নকল!

 সতীশ। নন্দীর নকল সাধে করি? তার প্রতি যখন ব্যক্তিবিশেষের পক্ষপাত—

 নলিনী। তবে যাও, তোমার সঙ্গে আর আমি কথা কব না।

 সতীশ। আচ্ছা, মাপ করো, আমি চুপ করে শুনব।

 নলিনী। দেখো সতীশ, মিস্টার নন্দী আমাকে নির্বোধের মতো একটা দামি ব্রেসলেট পাঠিয়েছিলেন, তুমি অমনি নির্বুদ্ধিতার সুর চড়িয়ে তার চেয়ে দামি একটা নেকলেস পাঠাতে গেলে কেন।

 সতীশ। যে-অবস্থায় লোকের বিবেচনাশক্তি থাকে না সে-অবস্থাটা তোমার জানা নেই ব’লে তুমি রাগ করছ, নেলি।

 নলিনী। আমার সাত জন্মে জেনে কাজ নেই। কিন্তু, এ নেকলেস তোমাকে ফিরে নিয়ে যেতে হবে।

 সতীশ। ফিরে দেবে?

 নলিনী। দেব। বাহাদুরি দেখাবার জন্যে যে-দান, আমার কাছে সে-দানের কোনো মূল্য নেই।

 সতীশ। তুমি অন্যায় বলছ, নেলি।

 নলিনী। আমি কিছুই অন্যায় বলছি নে—তুমি যদি আমাকে একটি ফুল দিতে আমি ঢের বেশি খুশি হতেম। তুমি যখন-তখন প্রায়ই মাঝে-মাঝে আমাকে কিছু-না-কিছু দামি জিনিস পাঠাতে আরম্ভ করেছ। পাছে তোমার মনে লাগে বলে আমি এতদিন কিছুই বলি নি। কিন্তু, ক্রমেই মাত্রা বেড়ে চলেছে, আর আমার চুপ করে থাকা উচিত নয়। এই নাও তোমার নেকলেস।

 সতীশ। এ নেকলেস তুমি রাস্তায় টান মেরে ফেলে দাও, কিন্তু আমি এ কিছুতেই নেব না।

 নলিনী। আচ্ছা সতীশ, আমি তো তোমাকে ছেলেবেলা হতেই জানি, আমার কাছে ভাঁড়িয়ো না। সত্য করে বলো, তোমার কি অনেক টাকা ধার হয় নি।

 সতীশ। কে তোমাকে বলেছে। নরেন বুঝি?

 নলিনী। কেউ বলে নি। আমি তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারি। আমার জন্যে তুমি এমন অন্যায় কেন করছ।

 সতীশ। সময়বিশেষে লোকবিশেষের জন্য মানুষ প্রাণ দিতে ইচ্ছা করে; আজকালকার দিনে প্রাণ দেবার অবকাশ খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্তত ধার করবার দুঃখটুকু স্বীকার করবার যে সুখ তাও কি ভোগ করতে দেবে না। আমার পক্ষে যা দুঃসাধ্য আমি তোমার জন্য তাই করতে চাই, নেলি, একেও যদি তুমি নন্দীসাহেবের নকল বল তবে আমার পক্ষে মর্মান্তিক হয়।

 নলিনী। আচ্ছা, তোমার যা করবার তা তো করেছ—তোমার সেই ত্যাগস্বীকারটুকু আমি নিলেম—এখন এ জিনিসটা ফিরে নাও।

 সতীশ। ওটা যদি আমাকে ফিরিয়ে নিতে হয় তবে ঐ নেকলেসটা গলায় ফাঁস লাগিয়ে দম বন্ধ করে আমার পক্ষে মরা ভালো।

 নলিনী। দেনা তুমি শোধ করবে কী করে।

 সতীশ। মার কাছ হতে টাকা পাব।

 নলিনী। ছি ছি, তিনি মনে করবেন, আমার জন্যই তাঁর ছেলের দেনা হচ্ছে।

 সতীশ। সে-কথা তিনি কখনোই মনে করবেন না, তাঁর ছেলেকে তিনি অনেকদিন হতে জানেন।

 নলিনী। আচ্ছা, সে যাই হোক, তুমি প্রতিজ্ঞা করো, এখন হতে তুমি আমাকে দামি জিনিস দেবে না। বড়োজোর ফুলের তোড়ার বেশি আর কিছু দিতে পারবে না।

 সতীশ। আচ্ছা, সেই প্রতিজ্ঞাই করলেম।

 নলিনী। যাক, এখন তবে তোমার গুরু নন্দীসাহেবের পাঠ আবৃত্তি করো। দেখি, স্তুতিবাদ করবার বিদ্যা তোমার কতদূর অগ্রসর হল। আচ্ছা, আমার কানের ডগা সম্বন্ধে কী বলতে পার বলো—আমি তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিলেম।

 সতীশ। যা বলব তাতে ঐ ডগাটুকু লাল হয়ে উঠবে।

 নলিনী। বেশ বেশ, ভূমিকাটা মন্দ হয় নি। আজকের মতো এইটুকু থাক, বাকিটুকু আর-একদিন হবে। এখনই কান ঝাঁ ঝাঁ করতে শুরু হয়েছে।

নবম পরিচ্ছেদ

 বিধু। আমার উপর রাগ কর যা কর, ছেলের উপর কোরো না। তোমার পায়ে ধরি, এবারকার মতো তার দেনাটা শোধ করে দাও।

 মন্মথ। আমি রাগারাগি করছি নে, আমার যা কর্তব্য তা আমাকে করতেই হবে। আমি সতীশকে বার বার বলেছি, দেনা করলে শোধবার ভার আমি নেব না। আমার সে কথার অন্যথা হবে না।

 বিধু। ওগো, এতবড়ো সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠির হলে সংসার চলে না। সতীশের এখন বয়স হয়েছে, তাকে জলপানি যা দাও তাতে ধার না করে তার চলে কী করে বলো দেখি।  মন্মথ। যার যেরূপ সাধ্য তার চেয়ে চাল বড়ো করলে কারোই চলে না— ফকিরেরও না, বাদশারও না।

 বিধু। তবে কি ছেলেকে জেলে যেতে হবে।

 মন্মথ। সে যদি যাবার আয়োজন করে এবং তোমরা যদি তার জোগাড় দাও, তবে আমি ঠেকিয়ে রাখব কী করে।

মন্মথর প্রস্থান। শশধরের প্রবেশ

 শশধর। আমাকে এ বাড়িতে দেখলে মন্মথ ভয় পায়। ভাবে, কালো কোর্তা ফরমাশ দেবার জন্য ফিতা হাতে তার ছেলের গায়ের মাপ নিতে এসেছি। তাই কদিন আসি নি। আজ তোমার চিঠি পেয়ে সুকু কান্নাকাটি করে আমাকে বাড়িছাড়া করেছে।

 বিধু। দিদি আসেন নি?

 শশধর। তিনি এখনি আসবেন। ব্যাপারটা কী।

 বিধু। সবই তো শুনেছ। এখন ছেলেটাকে জেলে না দিলে ওঁর মন সুস্থির হচ্ছে না। র‍্যাঙ্কিন-হার্মানের পোশাক তাঁর পছন্দ হল না, জেলখানার কাপড়টাই বোধ হয় তাঁর মতে বেশ সুসভ্য।

 শশধর। আর যাই বল, মন্মথকে বোঝাতে যেতে আমি পারব না। তার কথা আমি বুঝি নে, আমার কথাও সে বোঝে না, শেষকালে—

 বিধু। সে কি আমি জানি নে। তোমরা তো তাঁর স্ত্রী নও যে মাথা হেঁট করে সমস্তই সহ্য করবে। কিন্তু, এখন এ বিপদ ঠেকাই কী করে।

 শশধর। তোমার হাতে কিছু কি—

 বিধু। কিছুই নেই—সতীশের ধার শুধতে আমার প্রায় সমস্ত গহনাই বাঁধা পড়েছে, হাতে কেবল বালাজোড়া আছে।

সতীশের প্রবেশ

 শশধর। কী সতীশ, খরচপত্র বিবেচনা করে কর না, এখন কী মুশকিলে পড়েছ দেখো দেখি।

 সতীশ। মুশকিল তো কিছুই দেখি নে।

 শশধর। তবে হাতে কিছু আছে বুঝি! ফাঁস কর নি।

 সতীশ। কিছু তো আছেই।

 শশধর। কত?

 সতীশ। আফিম কেনবার মতো।

 বিধু। (কাঁদিয়া উঠিয়া) সতীশ, ও কী কথা তুই বলিস, আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি, আমাকে আর দগ্ধাস নে।

 শশধর। ছি ছি, সতীশ। এমন কথা যদিবা কখনো মনেও আসে তবু কি মার সামনে উচ্চারণ করা যায়। বড়ো অন্যায় কথা।

সুকুমারীর প্রবেশ

 বিধু। দিদি, সতীশকে রক্ষা করো। ও কোন্‌দিন কী করে বসে আমি তো ভয়ে বাঁচি নে। ও যা বলে শুনে আমার গা কাঁপে।

 সুকুমারী। ও আবার কী বলে।

 বিধু। বলে কিনা আফিম কিনে আনবে।

 সুকুমারী। কী সর্বনাশ। সতীশ, আমার গা ছুঁয়ে বল, এমন কথা মনেও আনবি নে। চুপ করে রইলি যে? লক্ষী বাপ আমার! তোর মা-মাসীর কথা মনে করিস।

 সতীশ। জেলে বসে মনে করার চেয়ে এ-সমস্ত হাস্যকর ব্যাপার জেলের বাইরে চুকিয়ে ফেলাই ভাল।

 সুকুমারী। আমরা থাকতে তোকে জেলে কে নিয়ে যাবে।

 সতীশ। পেয়াদা।

 সুকুমারী। আচ্ছা, সে দেখব কতবড়ো পেয়াদা; ওগো, এই টাকাটা ফেলে দাও-না, ছেলেমানুষকে কেন কষ্ট দেওয়া।

 শশধর। টাকা ফেলে দিতে পারি, কিন্তু মন্মথ আমার মাথায় ইঁট ফেলে না মারে।

 সতীশ। মেসোমশায়, সে ইঁট তোমার মাথায় পৌঁছবে না, আমার ঘাড়ে পড়বে। একে এক্‌জামিনে ফেল করেছি, তার উপরে দেনা, এর উপরে জেলে যাবার এতবড়ো সুযোেগটা যদি মাটি হয়ে যায় তবে বাবা আমার সে অপরাধ মাপ করবেন না।

 বিধু। সত্যি, দিদি। সতীশ মেশোর টাকা নিয়েছে শুনলে তিনি বোধ হয় ওকে বাড়ি হতে বার করে দেবেন।

 সুকুমারী। তা দিন-না। আর কি কোথাও বাড়ি নেই নাকি। ও বিধু, সতীশকে তুই আমাকেই দিয়ে দে-না। আমার তো ছেলেপুলে নেই, আমি নাহয় ওকেই মানুষ করি। কী বল গো।

 শশধর। সে তো ভালোই। কিন্তু, সতীশ যে বাঘের বাচ্ছা, ওকে টানতে গেলে তার মুখ থেকে প্রাণ বাঁচাননা দায় হবে।

 সকুমারী। বাঘমশায় তো বাচ্ছাটিকে জেলের পেয়াদার হাতেই সমর্পণ করে দিয়েছেন, আমরা যদি তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাই এখন তিনি কোনো কথা বলতে পারবেন না।

 শশধর। বাঘিনী কী বলেন, বাচ্ছাই বা কী বলে।

 সুকুমারী। যা বলে সে আমি জানি, সে কথা আর জিজ্ঞাসা করতে হবে না। তুমি এখন দেনাটা শােধ করে দাও।

 বিধু। দিদি!

 সকুমারী। আর দিদি-দিদি করে কাঁদতে হবে না। চল, তাের চুল বেঁধে দিই গে। এমন ছিরি করে তাের ভগ্নীপতির সামনে বার হতে লজ্জা করে না?

শশধর ব্যতীত সকলের প্রস্থান। মন্মথের প্রবেশ

 শশধর। মন্মথ, ভাই, তুমি একটু বিবেচনা করে দেখাে—

 মন্মথ। বিবেচনা না করে তাে আমি কিছুই করি না।

 শশধর। তবে দোহাই তােমার, বিবেচনা একটু খাটো করাে। ছেলেটাকে কি জেলে দেবে। তাতে কি ওর ভালাে হবে।

 মন্মথ। ভালােমন্দর কথা কেউই শেষ পর্যন্ত ভেবে উঠতে পারে না। আমি মােটামটি এই বুঝি যে, বার বার সাবধান করে দেওয়ার পরও যদি কেউ অন্যায় করে তবে তার ফলভােগ হতে তাকে কৃত্রিম উপায়ে রক্ষা করা কারও উচিত হয় না। আমরা যদি মাঝে পড়ে ব্যর্থ করে না দিতেম তবে প্রকৃতির কঠিন শিক্ষায় মানুষ যথার্থ মানুষ হয়ে উঠতে পারত।

 শশধর। প্রকৃতির কঠোর শিক্ষাই যদি একমাত্র শিক্ষা হত তবে বিধাতা বাপমায়ের মনে স্নেহটুকু দিতেন না। মন্মথ, তুমি যে দিনরাত কর্মফল-কর্মফল কর আমি তা সম্পূর্ণ মানি না। প্রকৃতি আমাদের কাছ হতে কর্মফল কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নিতে চায় কিন্তু প্রকৃতির উপরে যিনি কর্তা আছেন তিনি মাঝে পড়ে তার অনেকটাই মহ্‌কুপ দিয়ে থাকেন, নইলে কর্মফলের দেনা শুধতে শুধতে আমাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিকিয়ে যেত। বিজ্ঞানের হিসাবে কর্মফল সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানের উপরেও বিজ্ঞান আছে, সেখানে প্রেমের হিসাবে ফলাফল সমস্ত অন্যরকম। কর্মফল নৈসর্গিক মার্জনাটা তার উপরের কথা।

 মন্মথ। যিনি অনৈসর্গিক মানুষ যা-খুশি করবেন; আমি অতি সামান্য নৈসর্গিক, আমি কর্মফল শেষ পর্যন্তই মানি।

 শশধর। আচ্ছা, আমি যদি সতীশের দেনা শােধ করে তাকে খালাস করি, তুমি কী করবে।

 মন্মথ। আমি তাকে ত্যাগ করব। দেখাে, সতীশকে আমি যে ভাবে মানুষ করতে চেয়েছিলেম প্রথম হতেই বাধা দিয়ে তােমরা তা ব্যর্থ করেছ। এক দিক হতে সংযম আর-এক দিক হতে প্রশ্রয় পেয়ে সে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ক্রমাগতই ভিক্ষা পেয়ে যদি তার সম্মানবােধ এবং দায়িত্ববােধ চলে যায়, যে কাজের যে পরিণাম তােমরা যদি মাঝে পড়ে কিছুতেই তাকে তা বুঝতে না দাও, তবে তার আশা আমি ত্যাগ করলেম। তােমাদের মতেই তাকে মানুষ করাে—দুই নৌকায় পা দিয়েই তার বিপদ ঘটেছে।

 শশধর। ও কী কথা বলছ, মন্মথ-তােমার ছেলে—

 মন্মথ। দেখাে শশধর, নিজের প্রকৃতি ও বিশ্বাসমতেই নিজের ছেলেকে আমি মানুষ করতে পারি, অন্য কোনাে উপায় তাে জানি না। যখন নিশ্চয় দেখছি তা কোনােমতেই হবার নয়, তখন পিতার দায়িত্ব আমি আর রাখব না। আমার যা সাধ্য তার বেশি আমি করতে পারব না।

মন্মথর প্রস্থান

 শশধর। কী করা যায়। ছেলেটাকে তাে জেলে দেওয়া যায় না! অপরাধ মানুষের পক্ষে যত সর্বনেশেই হােক, জেলখানা তার চেয়ে ঢের বেশি।

দশম পরিচ্ছেদ

 ভাদুড়িজায়া। শুনেছ? সতীশের বাপ হঠাৎ মারা গেছে।

 মিস্টার ভাদুড়ি। হাঁ, সে তো শুনেছি।

 জায়া। সে-যে সমস্ত সম্পত্তি হাসপাতালে দিয়ে গেছে, কেবল সতীশের মার জন্য জীবিতকাল পর্যন্ত ৭৫ টাকা মাসহারা বরাদ্দ করে গেছে। এখন কী করা যায়।

 ভাদুড়ি। এত ভাবনা কেন তােমার।

 জায়া। বেশ লােক যা হােক তুমি! তােমার মেয়ে যে সতীশকে ভালােবাসে, সেটা বুঝি তুমি দুই চক্ষু মেলে দেখতে পাও না? তুমি তাে ওদের বিবাহ দিতেও প্রস্তুত ছিলে। এখন উপায় কী করবে।

 ভাদুড়ি। আমি তাে মন্মথর টাকার উপর বিশেষ নির্ভর করি নি।

 জায়া। তবে কি ছেলেটির চেহারার উপরেই নির্ভর করে বসে ছিলে। অন্নবস্ত্রটা বুঝি অনাবশ্যক?

 ভাদুড়ি। সম্পূর্ণ আবশ্যক, যিনি যাই বলুন, ওর চেয়ে আবশ্যক আর-কিছুই নেই। সতীশের একটি মেসো আছে, বােধহয় জান।

 জায়া। মেসো তাে ঢের লােকেরই থাকে, তাতে শান্তি হয় না।

 ভাদুড়ি। এই মেসোটি আমার মক্কেল—অগাধ টাকা—ছেলেপুলে কিছুই নেই—বয়সও নিতান্ত অল্প নয়। সে তাে সতীশকেই পােষ্যপুত্র নিতে চায়।

 জায়া। মেসােটি তাে ভালাে। তা চট্‌পট্‌ নিক-না। তুমি একটু তাড়া দাওনা।

 ভাদুড়ি। তাড়া আমাকে দিতে হবে না, তার ঘরের মধ্যেই তাড়া দেবার লােক আছে। সবই প্রায় ঠিকঠাক, এখন কেবল একটা আইনের খটকা উঠেছে—এক ছেলেকে পােষ্যপুত্র লওয়া যায় কি না—তা ছাড়া সতীশের আবার বয়স হয়ে গেছে।

 জায়া। আইন তাে তােমাদেরই হাতে—তােমরা চোখ বুজে একটা বিধান দিয়ে দাও-না।

 ভাদুড়ি। ব্যস্ত হােয়ো না—পােষ্যপত্র না নিলেও অন্য উপায় আছে।

 জায়া। আমাকে বাঁচালে। আমি ভাবছিলেম, সম্বন্ধ ভাঙি কী করে। আবার, আমাদের নেলি যেরকম জেদালাে মেয়ে সে যে কী করে বসত বলা যায় না। কিন্তু তাই বলে গরিবের হাতে তাে মেয়ে দেওয়া যায় না। ঐ দেখাে, তােমার মেয়ে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে। কাল যখন খেতে বসেছিল এমন সময় সতীশের বাপ-মরার খবর পেল, অমনি তখনি উঠে চলে গেল।

 ভাদুড়ি। কিন্তু, নেলি যে সতীশকে ভালােবাসে সে তাে দেখে মনে হয় না। ও তাে সতীশকে নাকের জলে চোখের জলে করে। আমি আরও মনে করতাম, নন্দীর উপরেই ওর বেশি টান।

 জায়া। তােমার মেয়েটির ঐ স্বভাব—সে যাকে ভালােবাসে তাকেই জ্বালাতন করে। দেখােনা, বিড়ালছানাটাকে নিয়ে কী কাণ্ডটাই করে! কিন্তু, আশ্চর্য এই, তবু তাে ওকে কেউ ছাড়তে চায় না।

নলিনীর প্রবেশ

 নলিনী। মা, একবার সতীশবাবুর বাড়ি যাবে না? তাঁর মা বােধহয় খুব কাতর হয়ে পড়েছেন।—বাবা, আমি একবার তাঁর কাছে যেতে চাই।

একাদশ পরিচ্ছেদ

 সতীশ। মা, এখানে আমি যে কত সুখে আছি সে তো আমার কাপড়-চোপড় দেখেই বুঝতে পার। কিন্তু, মেলােমশায় যতক্ষণ না আমাকে পােষ্যপুত্র গ্রহণ করেন ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হতে পারছি নে। তুমি যে মাসহারা পাও আমার তাে তাতে কোনাে সাহায্য হবে না। অনেক দিন হতে নেব-নেব করেও আমাকে পােষ্যপুত্র নিচ্ছেন না—বােধহয় ওঁদের মনে মনে সন্তানলাভের আশা এখনাে আছে।

 বিধু। (হতাশভাবে) সে আশা সফল হয় বা, সতীশ।

 সতীশ। অ্যাঁ! বলাে কী মা!

 বিধু। লক্ষণ দেখে তাে তাই বােধ হয়।

 সতীশ। লক্ষণ অমন অনেকসময় ভুলও তাে হয়।

 বিধু। না, ভুল নয় সতীশ, এবার তাের ভাই হবে।

 সতীশ। কী যে বল মা, তার ঠিক নেই—ভাই হবেই কে বললে! বােন হতে পারে না বুঝি!

 বিধু। দিদির চেহারা যেরকম হয়ে গেছে নিশ্চয় তাঁর মেয়ে হবে না, ছেলেই হবে। তা ছাড়া ছেলেই হােক, মেয়েই হােক, আমাদের পক্ষে সমানই।

 সতীশ। এত বয়সের প্রথম ছেলে, ইতিমধ্যে অনেক বিঘ্ন ঘটতে পারে।

 বিধু। সতীশ, তুই চাকরির চেষ্টা কর্।

 সতীশ। অসম্ভব। পাস করতে পারি নি। তা ছাড়া চাকরি করবার অভ্যাস আমার একেবারে গেছে। কিন্তু, যাই বল মা, এ ভারি অন্যায়। আমি তাে এতদিনে বাবার সম্পত্তি পেতেম, তার থেকে বঞ্চিত হলেম, তার পরে যদি আবার—

 বিধু। অন্যায় নয় তাে কী, সতীশ। এ দিকে তােকে ঘরে এনেছেন, ও দিকে আবার ডাক্তার ডাকিয়ে ওষুধও খাওয়া চলছে। নিজের বােনপাের সঙ্গে এ কী রকম ব্যবহার। শেষকালে দয়াল ডাক্তারের ওষুধ তাে খেটে গেল। অস্থির হােস নে, সতীশ। একমনে ভগবানকে ডাক; তাঁর কাছে কোনাে ডাক্তারই লাগে না। তিনি যদি—

 সতীশ। আহা, তিনি যদি এখনাে—এখনাে সময় আছে। মা, এঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, কিন্তু যেরকম অন্যায় হল সে ভাব রক্ষা করা শক্ত হয়ে উঠেছে। ঈশ্বরের কাছে এঁদের একটা দুর্ঘটনা না প্রার্থনা করে থাকতে পারছি নে—তিনি দয়া করে যেন—

 বিধু। আহা তাই হােক, নইলে তাের উপায় কী হবে সতীশ, আমি তাই ভাবি। হে ভগবান, তুমি যেন—

 সতীশ। এ যদি না হয় তবে ঈশ্বরকে আমি আর মানব না। কাগজে নাস্তিকতা প্রচার করব।

 বিধু। আরে চুপ চুপ, এখন এমন কথা মুখে আনতে নেই। তিনি দয়াময়, তাঁর দয়া হলে কী না ঘটতে পারে। সতীশ, তুই আজ এত ফিট্‌ফাট সাজ করে কোথায় চলেছিস। উঁচু কলার প’রে মাথা যে আকাশে গিয়ে ঠেকল। ঘাড় হেঁট করবি কী করে।

 সতীশ। এমনি করে কলারের জোরে যতদিন মাথা তুলে চলতে পারি চলব, তার পরে ঘাড় হেঁট করবার দিন যখন আসবে তখন এগুলাে ফেলে দিলেই চলবে। বিশেষ কাজ আছে মা, চললেম; কথাবার্তা পরে হবে।

প্রস্থান

 বিধু। কাজ কোথায় আছে তা জানি। মা গাে, ছেলের আর তর সয় না। এ বিবাহটা ঘটবেই। আমি জানি, আমার সতীশের অদৃষ্ট খারাপ নয়; প্রথমে বিঘ্ন যতই ঘটক শেষকালটায় ওর ভালাে হয়ই, এ আমি বরাবর দেখে আসছি। না হবেই বা কেন। আমি তাে জ্ঞাতসারে কোনাে পাপ করি নি—আমি তাে সতী স্ত্রী ছিলাম, সেইজন্য আমার খুব বিশ্বাস হচ্ছে, দিদির এবারে—

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

 সুকুমারী। সতীশ!

 সতীশ। কী, মাসিমা।

 সুকুমারী। কাল যে তােমাকে খোকার কাপড় কিনে আনবার জন্য এত করে বললেম, অপমান বােধ হল বুঝি?

 সতীশ। অপমান কিসের, মাসিমা। কাল ভাদুড়িসাহেবের ওখানে আমার নিমন্ত্রণ ছিল তাই—

 সুকুমারী। ভাদুড়িসাহেবের ওখানে তােমার এত ঘন ঘন যাতায়াতের দরকার কী, তা তাে ভেবে পাই নে। তারা সাহেবমানুষ, তােমার মতাে অবস্থার লােকের কি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সাজে। আমি তাে শুনেলেম, তােমাকে তারা আজকাল পোঁছে না, তবু বুঝি ঐ রঙিন টাইয়ের উপর টাইরিং প’রে বিলাতি কার্তিক সেজে তাদের ওখানে আনাগােনা করতেই হবে? তােমার কি একটুও সম্মনবােধ নেই। তাই যদি থাকবে তবে কি কাজকর্মের কোনাে চেষ্টা না করে এখানে এমন করে পড়ে থাকতে। তার উপরে আবার একটা কাজ করতে বললে মনে মনে রাগ করা হয়, পাছে ওকে কেউ বাড়ির সরকার মনে করে ভুল করে; কিন্তু, সরকারও তাে ভালাে—সে খেটে উপার্জন করে খায়।

 সতীশ। মাসিমা, আমিও হয়তাে তা পারতেম, কিন্তু তুমিই তাে—

 সুকুমারী। তাই বটে। জানি, শেষকালে আমারই দোষ হবে। এখন বুঝেছি, তােমার বাপ তােমাকে ঠিক চিনতেন। তাই তােমাকে এমন করে শাসনে রেখেছিলেন। আমি আরও ছেলেমানুষ বলে দয়া করে তােমাকে ঘরে স্থান দিলেম, জেল থেকে বাঁচালেম, শেষকালে আমারই দোষ হল। একেই বলে কৃতজ্ঞতা। আচ্ছা, আমারই নাহয় দোষ হল, তব, যে কদিন এখানে আমাদের অন্ন খাচ্ছ দরকার-মতো দুটো কাজই নাহয় করে দিলে। এমন কি কেউ করে না। এতে কি অত্যন্ত অপমান বোধ হয়।

 সতীশ। কিছু না, কিছু না, কী করতে হবে বলো, আমি এখনি করছি।

 সুকুমারী। খোকার জন্য সাড়ে সাত গজ রেন্‌বো সিল্ক চাই—আর একটা সেলার সুট—

সতীশের প্রস্থানোদ্যম

 শোনো, শোনো, ওর মাপটা নিয়ে যেয়ো, জুতো চাই।

সতীশ প্রস্থানোন্মুখ

 অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন—সবগুলো ভালো করে শুনেই যাও। আজও বুঝি ভাদুড়িসাহেবের রুটি বিস্কুট খেতে যাবার জন্য প্রাণ ছট্‌ফট্‌ করছে। খোকার জন্যে স্ট্র-হ্যাট এনো—আর তার রুমালও এক ডজন চাই।

সতীশের প্রস্থান। তাহাকে পুনরায় ডাকিয়া

 শোনো সতীশ, আর-একটা কথা আছে। শুনলাম, তোমার মেসোর কাছ হতে তুমি নূতন সুট কেনবার জন্য আমাকে না বলে টাকা চেয়ে নিয়েছ। যখন নিজের সামর্থ্য হবে তখন যত খুশি সাহেবিয়ানা কোরো, কিন্তু পরের পয়সায় ভাদুড়িসাহেবদের তাক লাগিয়ে দেবার জন্য মেসোকে ফতুর করে দিয়ো না। সে টাকাটা আমাকে ফেরত দিয়ো। আজকাল আমাদের বড়ো টানাটানির সময়।

 সতীশ। আচ্ছা, এনে দিচ্ছি।

 সুকুমারী। এখন তুমি দোকানে যাও, সেই টাকা দিয়ে কিনে বাকিটা ফেরত দিয়ো। একটা হিসাব রাখতে ভুলো না যেন।

সতীশের প্রস্থানোদ্যম

 শোনো সতীশ—এই কটা জিনিস কিনতে আবার যেন আড়াই টাকা গাড়িভাড়া লাগিয়ে বোসো না। ঐজন্যে তোমাকে কিছু আনতে বলতে ভয় করে। দু পা হেঁটে চলতে হলেই অমনি তোমার মাথায় মাথায় ভাবনা পড়ে—পরুষমানুষ এত বাবু হলে তো চলে না। তোমার বাবা রোজ সকালে নিজে হেঁটে গিয়ে নতুন বাজার হতে কই মাছ কিনে আনতেন—মনে আছে তো? মুটেকেও তিনি এক পয়সা দেন নি।

 সতীশ। তোমার উপদেশ মনে থাকবে—আমিও দেব না। আজ হতে তোমার এখানে মুটেভাড়া, বেহারার মাইনে, যত অল্প লাগে সে দিকে আমার সর্বদাই দৃষ্টি থাকবে।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

 হরেন। দাদা, তুমি অনেকক্ষণ ধরে ও কী লিখছ, কাকে লিখছ বলোনা।

 সতীশ। যা যা, তোর সে খবরে কাজ কী, তুই খেলা কর্‌গে যা।

 হরেন। দেখি-না কী লিখছ—আমি আজকাল পড়তে পারি।

 সতীশ। হরেন, তুই আমাকে বিরক্ত করিস নে বলছি—যা তুই।

 হরেন। ভয়ে আকার ভা, ল, ভাল, বয়ে আকার বা, সয়ে আকার সা, ভালোবাসা। দাদা, কী ভালোবাসার কথা লিখছ বলো-না। তুমি কাঁচা পেয়ারা ভালোবাস বুঝি? আমিও বাসি।

 সতীশ। আঃ হরেন, অত চেঁচাস নে, ভালোবাসার কথা আমি লিখি নি।

 হরেন। অ্যাঁ! মিথ্যা কথা বলছ! আমি যে পড়লেম ভয়ে আকার, ভা, ল, বয়ে আকার সয়ে আকার ভালোবাসা। আচ্ছা, মাকে ডাকি, তাঁকে দেখাও।

 সতীশ। না না, মাকে ডাকতে হবে না। লক্ষীটি, তুই একটু খেলা করতে যা। আমি এইটে শেষ করি।

 হরেন। এটা কী, দাদা। এ যে ফুলের তোড়া। আমি নেব।

 সতীশ। ওতে হাত দিস নে, হাত দিস নে, ছিঁড়ে ফেলবি।

 হরেন। না, আমি ছিঁড়ে ফেলব না, আমাকে দাও-না।

 সতীশ। খোকা, কাল তোকে আমি অনেক তোড়া এনে দেব, এটা থাক্।

 হরেন। দাদা, এটা বেশ, আমি এইটেই নেব।

 সতীশ। না, এ আর-একজনের জিনিস, আমি তোকে দিতে পারব না।

 হরেন। হ্যাঁ, মিথ্যে কথা! আমি তোমাকে লজঞ্জুস আনতে বলেছিলেম, তুমি সেই টাকায় তোড়া কিনে এনেছ—তাই বইকি, আর-একজনের জিনিস বইকি।

 সতীশ। হরেন, লক্ষী ভাই, তুই একটুখানি চুপ কর, চিঠিখানা শেষ করে ফেলি। কাল তোকে আমি অনেক লজঞ্জুস কিনে এনে দেব।

 হরেন। আচ্ছা, তুমি কী লিখছ আমাকে দেখাও।

 সতীশ। আচ্ছা দেখাব, আগে লেখাটা শেষ করি।

 হরেন। তবে আমিও লিখি।

স্লেট লইয়া চীৎকারস্বরে

 ভয়ে আকার ভা, ল, ভাল, বয়ে আকার বা, সয়ে আকার সা, ভালোবাসা।

 সতীশ। চুপ চুপ, অত চীৎকার করিস নে। আঃ, থাম্ থাম্।

 হরেন। তবে আমাকে তোড়াটা দাও।

 সতীশ। আচ্ছা নে, কিন্তু খবরদার ছিঁড়িস নে—ও কী করলি! যা বারণ করলেম তাই! ফুলটা ছিঁড়ে ফেললি! এমন বদ ছেলেও তো দেখি নি।

তোড়া কাড়িয়া লইয়া চপেটাঘাত করিয়া

 লক্ষ্মীছাড়া কোথাকার! যা, এখান থেকে যা বলছি! যা!

হরেনের চীৎকারস্বরে ক্রন্দন, সতীশের সবেগে প্রস্থান

বিধুমুখীর ব্যস্ত হইয়া প্রবেশ

 বিধু। সতীশ বুঝি হরেনকে কাঁদিয়েছে, দিদি টের পেলে সর্বনাশ হবে। হরেন, বাপ আমার, কাঁদিস নে, লক্ষী আমার, সোনা আমার।

 হরেন। (সরোদনে) দাদা আমাকে মেরেছে।

 বিধু। আচ্ছা আচ্ছা, চুপ কর্ চুপ কর্। আমি দাদাকে খুব করে মারব এখন।

 হরেন। দাদা ফুলের তোড়া কেড়ে নিয়ে গেল।

 বিধু। আচ্ছা, সে আমি তার কাছ থেকে নিয়ে আসছি।

হরেনের ক্রন্দন

 এমন ছিচকাঁদুনে ছেলেও তো আমি কখনো দেখি নি। দিদি আদর দিয়ে ছেলেটির মাথা খাচ্ছেন। যখন যেটি চায় তখনি সেটি তাকে দিতে হবে। দেখো-না, একবারে দোকান ঝাঁটিয়ে কাপড়ই কেনা হচ্ছে। যেন নবাবপত্র। ছি ছি, নিজের ছেলেকে কি এমনি করেই মাটি করতে হয়।

সতর্জনে

 খোকা, চুপ কর্ বলছি। ঐ হামদোবুড়ো আসছে!

সুকুমারীর প্রবেশ

 সুকুমারী। বিধু, ও কী ও। আমার ছেলেকে কি এমনি করেই ভূতের ভয় দেখাতে হয়। আমি চাকর-বাকরদের বারণ করে দিয়েছি, কেউ ওর কাছে ভূতের কথা বলতে সাহস করে না। আর, তুমি বুঝি মাসি হয়ে ওর এই উপকার করতে বসেছ! কেন বিধু, আমার বাছা তোমার কী অপরাধ করেছে। ওকে তুমি দুটি চক্ষে দেখতে পার না, তা আমি বেশ বুঝেছি। আমি বরাবর তোমার ছেলেকে পেটের ছেলের মতো মানুষ করলেম, আর তুমি বুঝি আজ তারই শোধ নিতে এসেছ!

 বিধু। (সরোদনে) দিদি, এমন কথা বোলো না। আমার কাছে আমার সতীশ আর তোমার হরেনে প্রভেদ কী আছে।

 হরেন। মা, দাদা আমাকে মেরেছে।

 বিধু। ছি ছি, খোকা, মিথ্যা বলতে নেই। দাদা তোর এখানে ছিলই না তা মারবে কী করে।

 হরেন। বাঃ—দাদা যে এইখানে বসে চিঠি লিখছিল—তাতে ছিল ভয়ে আকার ভা, ল, ভাল, বয়ে আকার সয়ে আকার, ভালোবাসা। মা, তুমি আমার জন্যে দাদাকে লজঞ্জুস আনতে বলেছিলে, দাদা সেই টাকায় ফুলের তোড়া কিনে এনেছে—তাতেই আমি একটু হাত দিয়েছিলেম বলেই অমনি আমাকে মেরেছে।

 সুকুমারী। তোমরা মায়ে পোয় মিলে আমার ছেলের সঙ্গে লেগেছ বুঝি? ওকে তোমাদের সহ্য হচ্ছে না। ও গেলেই তোমরা বাঁচ। আমি তাই বলি, খোকা রোজ ডাক্তার-ক’বরাজের বোতল-বোতল ওষুধ গিলছে, তব, দিন-দিন এমন রোগা হচ্ছে কেন। ব্যাপারখানা আজ বোঝা গেল।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

 সতীশ। আমি তোমার কাছে বিদায় নিতে এসেছি, নেলি।

 নলিনী। কেন, কোথায় যাবে।

 সতীশ। জাহান্নমে।

 নলিনী। সে জায়গায় যাবার জন্য কি বিদায় নেবার দরকার হয়। যে লোক সন্ধান জানে সে তো ঘরে বসেই সেখানে যেতে পারে। আজ তোমার মেজাজটা এমন কেন। কলারটা বুঝি ঠিক হাল ফ্যাশানের হয় নি!

 সতীশ। তুমি কি মনে কর আমি কেবল কলারের কথাই দিনরাত্রি চিন্তা করি।

 নলিনী। তাই তো মনে হয়। সেইজন্যই তো হঠাৎ তোমাকে অত্যন্ত চিতশীলের মতো দেখায়।

 সতীশ। ঠাট্টা কোরো না নেলি, তুমি যদি আজ আমার হদয়টা দেখতে পেতে—

 নলিনী। তা হলে ডুমুরের ফল এবং সাপের পাঁচ পাও দেখতে পেতাম।

 সতীশ। আবার ঠাট্টা! তুমি বড়ো নিষ্ঠুর। সত্যই বলছি নেলি, আজ বিদায় নিতে এসেছি।

 নলিনী। দোকানে যেতে হবে?

 সতীশ। মিনতি করছি নেলি, ঠাট্টা করে আমাকে দগ্ধ কোরো না। আজ আমি চিরদিনের মতো বিদায় নেব।

 নলিনী। কেন, হঠাৎ সেজন্য তোমার এত বেশি আগ্রহ কেন।

 সতীশ। সত্যকথা বলি, আমি যে কত দরিদ্র তা তুমি জান না।

 নলিনী। সেজন্য তোমার ভয় কিসের। আমি তো তোমার কাছে টাকা ধার চাই নি।

 সতীশ। তোমার সঙ্গে আমার বিবাহের সম্বন্ধ হয়েছিল—

 নলিনী। তাই পালাবে? বিবাহ না হতেই হৃৎকম্প!

 সতীশ। আমার অবস্থা জানতে পেরে মিস্টার ভাদুড়ি আমাদের সম্বন্ধ ভেঙে দিলেন।

 নলিনী। অমনি সেই অপমানেই কি নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে হবে। এত বড়ো অভিমানী লোকের কারও সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ রাখা শোভা পায় না। সাধে আমি তোমার মুখে ভালোবাসার কথা শুনলেই ঠাট্টা করে উড়িয়ে দি।

 সতীশ। নেলি, তবে কি এখনও আমাকে আশা রাখতে বল।

 নলিনী। দোহাই সতীশ, অমন নভেলি ছাঁদে কথা বানিয়ে বোলো না, আমার হাসি পায়। আমি তোমাকে আশা রাখতে বলব কেন। আশা যে রাখে সে নিজের গরজেই রাখে, লোকের পরামর্শ শুনে রাখে না।

 সতীশ। সে তো ঠিক কথা। আমি জানতে চাই, তুমি দারিদ্র্যকে ঘণা কর কি না।

 নলিনী। খুব করি, যদি সে দারিদ্র্য মিথ্যার দ্বারা নিজেকে ঢাকতে চেষ্টা করে।

 সতীশ। নেলি, তুমি কি কখনো তোমার চিরকালের অভ্যস্ত আরাম ছেড়ে গরিবের ঘরের লক্ষ্মী হতে পারবে।

 নলিনী। নভেলে যেরকম ব্যারামের কথা পড়া যায়, সেটা তেমন করে চেপে ধরলে আরাম আপনি ঘরছাড়া হয়।

 সতীশ। সে ব্যারামের কোনো লক্ষণ কি তোমার—

 নলিনী। সতীশ, তুমি কখনো কোনো পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে পারলে না। স্বয়ং নন্দীসাহেবও বোধ হয় অমন প্রশ্ন তুলতেন না। তোমাদের একচুলও প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।

 সতীশ। তোমাকে আমি আজও চিনতে পারলেম না, নেলি।

 নলিনী। চিনবে কেমন করে। আমি তো তোমার হাল ফ্যাশানের টাই নই, কলার নই—দিনরাত যা নিয়ে ভাব তাই তুমি চেন।

 সতীশ। আমি হাত জোড় করে বলছি নেলি, তুমি আজ আমাকে এমন কথা বোলো না। আমি যে কী নিয়ে ভাবি তা তুমি নিশ্চয় জান—

 নলিনী। তোমার সম্বন্ধে আমার অন্তর্দৃষ্টি যে এত প্রখর তা এতটা নিঃসংশরে স্থির কোরো না। ঐ বাবা আসছেন। আমাকে এখানে দেখলে তিনি অনর্থক বিরক্ত হবেন, আমি যাই।

প্রস্থান

 সতীশ। মিস্টার ভাদুড়ি, আমি বিদায় নিতে এসেছি।

 ভাদুড়ি। আচ্ছা, তবে আজ—

 সতীশ। যাবার আগে একটা কথা আছে।

 ভাদুড়ি। কিন্তু সময় তো নেই, আমি এখন বেড়াতে বের হব।

 সতীশ। কিছুক্ষণের জন্য কি সঙ্গে যেতে পারি।

 ভাদুড়ি। তুমি যে পার তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমি পারব না। সম্প্রতি আমি সঙ্গীর অভাবে তত অধিক ব্যাকুল হয়ে পড়ি নি।

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

 শশধর। আঃ, কী বল। তুমি কি পাগল হয়েছ নাকি।

 সুকুমারী। আমি পাগল না তুমি চোখে দেখতে পাও না!

 শশধর। কোনোটাই আশ্চর্য নয়, দুটোই সম্ভব। কিন্তু—

 সুকুমারী। আমাদের হরেনের জন্ম হতেই দেখ নি ওদের মুখে কেমন হয়ে গেছে? সতীশের ভাবখানা দেখে বুঝতে পার না?

 শশধর। আমার অত ভাব বুঝবার ক্ষমতা নেই, সে তো তুমি জানই। মন জিনিসটাকে অদৃশ্য পদার্থ বলেই শিশুকাল হতে আমার কেমন একটা সংস্কার বদ্ধমূল হয়ে গেছে। ঘটনা দেখলে তবু কতকটা বুঝতে পারি।

 সকুমারী। সতীশ যখনই আড়ালে পায় তোমার ছেলেকে মারে, আবার বিধুও তার পিছনে পিছনে এসে খোকাকে জুজুর ভয় দেখায়।

 শশধর। ঐ দেখো, তোমরা ছোটো কথাকে বড়ো করে তোল। যদিই বা সতীশ খোকাকে কখনো—

 সুকুমারী। সে তুমি সহ্য করতে পার, আমি পারব না—ছেলেকে তো তোমার গর্ভে ধরতে হয় নি।

 শশধর। সে কথা আমি অস্বীকার করতে পারব না। এখন তোমার অভিপ্রায় কী শুনি।

 সুকুমারী। শিক্ষা সম্বন্ধে তুমি তো বড়ো বড়ো কথা বল, একবার তুমি ভেবে দেখো-না আমরা হরেনকে যে ভাবে শিক্ষা দিতে চাই তার মাসি তাকে অন্যরূপ শেখায়—সতীশের দৃষ্টান্তটিই বা তার পক্ষে কিরূপ সেটাও তো ভেবে দেখতে হয়।

 শশধর। তুমি যখন অত বেশি করে ভাবছ তখন তার উপরে আমার আর ভাববার দরকার কী আছে। এখন কর্তব্য কী বলো।

 সুকুমারী। আমি বলি, সতীশকে তুমি বলো, তার মার কাছে থেকে সে এখন কাজকর্মের চেষ্টা দেখুক। পুরুষমানুষ পরের পয়সায় বাবুগিরি করে, সে কি ভালো দেখতে হয়।

 শশধর। ওর মা যে টাকা পায় তাতে সতীশের চলবে কী করে।

 সুকুমারী। কেন, ওদের বাড়িভাড়া লাগে না, মাসে পঁচাত্তর টাকা কম কী।

 শশধর। সতীশের যেরূপ চাল দাঁড়িয়েছে, পঁচাত্তর টাকা তো সে চুরুটের ডগাতেই ফুঁকে দেবে। মার গহনাগাঁটি ছিল, সে তো অনেকদিন হল গেছে; এখন হবিষ্যান্ন বাঁধা দিয়ে তো দেনা শোধ হবে না!

 সুকুমারী। যার সামর্থ্য কম তার অত লম্বা চালেই বা দরকার কী।

 শশধর। মন্মথ তো সেই কথাই বলত। আমরাই তো সতীশকে অন্যরূপ বুঝিয়েছিলেম। এখন ওকে দোষ দিই কী করে।

 সুকুমারী। না-দোষ কি ওর হতে পারে। সব দোষ আমারই। তুমি তো আর কারও কোনো দোষ দেখতে পাও না—কেবল আমার বেলাতেই তোমার দর্শনশক্তি বেড়ে যায়।

 শশধর। ওগো, রাগ কর কেন—আমিও তো দোষী।

 সুকুমারী। তা হতে পারে। তোমার কথা তুমি জান। কিন্তু, আমি কখনো ওকে এমন কথা বলি নি যে, তুমি তোমার মেসোর ঘরে পায়ের উপর পা দিয়ে গোঁফে তা দাও, আর লম্বা কেদারায় বসে বসে আমার বাছার উপর বিষদৃষ্টি দিতে থাকো।

 শশধর। না, ঠিক ঐ কথাগুলো তুমি তাকে মাথার দিব্য দিয়ে শপথ করিয়ে নাও নি—অতএব তোমাকে দোষ দিতে পারি নে। এখন কী করতে হবে বলো।

 সকুমারী। সে তুমি যা ভালো বোধ কর তাই করো। কিন্তু, আমি বলছি, সতীশ যতক্ষণ এ বাড়িতে থাকবে, আমি খোকাকে কোনোমতে বাইরে যেতে দিতে পারব না। ডাক্তার খোকাকে হাওয়া খাওয়াতে বিশেষ করে বলে দিয়েছে—কিন্তু হাওয়া খেতে গিয়ে ও কখন একলা সতীশের নজরে পড়বে, সে কথা মনে করলে আমার মন স্থির থাকে না। ও তো আমারই আপন বোনের ছেলে, কিন্তু আমি ওকে এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করি নে—এ আমি তোমাকে স্পষ্টই বললেম।

সতীশের প্রবেশ

 সতীশ। কাকে বিশ্বাস কর না, মাসিমা। আমাকে? আমি তোমার খোকাকে সুযোেগ পেলে গলা টিপে মারব, এই তোমার ভয়? যদি মারি, তবে তুমি তোমার বোনের ছেলের যে অনিষ্ট করেছ তার চেয়ে ওর কি বেশি অনিষ্ট করা হবে। কে আমাকে ছেলেবেলা হতে নবাবের মতো শৌখিন করে তুলেছে এবং আজ ভিক্ষুকের মতো পথে বের করলে। কে আমাকে পিতার শাসন হতে কেড়ে এনে বিশ্বের লাঞ্ছনার মধ্যে টেনে আনলে। কে আমাকে—

 সুকুমারী। ওগো, শুনছ? তোমার সামনে আমাকে এমনি করে অপমান করে! নিজের মুখে বললে কিনা খোকাকে গলা টিপে মারবে! ওমা, কী হবে গো। আমি কালসাপকে নিজের হাতে দুধকলা দিয়ে পুষেছি।

 সতীশ। দুধকলা আমারও ঘরে ছিল—সে দুধকলায় আমার রক্ত বিষ হয়ে উঠত না—তা হতে চিরকালের মতো বঞ্চিত করে তুমি যে দুধকলা আমাকে খাইয়েছ তাতে আমার বিষ জমে উঠেছে। সত্য কথাই বলছ, এখন আমাকে ভয় করাই চাই—এখন আমি দংশন করতে পারি।

বিধুমুখীর প্রবেশ

 বিধু। কী সতীশ, কী হয়েছে, তোকে দেখে যে ভয় হয়। অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন। আমাকে চিনতে পারছিস নে? আমি যে তোর মা, সতীশ।

 সতীশ। মা, তোমাকে মা বলব কোন মুখে। মা হয়ে কেন তুমি আমার পিতার শাসন হতে আমাকে বঞ্চিত করলে। কেন তুমি আমাকে জেল হতে ফিরিয়ে আনলে। সে কি মাসির ঘর হতে ভয়ানক। তােমরা ঈশ্বরকে মা বলে ডাক’, তিনি যদি তােমাদের মতাে মা হন তবে তাঁর আদর চাই নে, তিনি যেন আমাকে নরকে দেন।

 শশধর। আঃ, সতীশ! চলাে চলাে—কী বকছ, থামাে। এসো, বাইরে আমার ঘরে এসাে।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

 শশধর। সতীশ, একটু ঠাণ্ডা হও। তােমার প্রতি অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে, সে কি আমি জানি নে। তােমার মাসি রাগের মুখে কী বলেছেন, সে কি অমন করে মনে নিতে আছে। দেখাে, গােড়ায় যা ভুল হয়েছে তা এখন যতটা সম্ভব প্রতিকার করা যাবে, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

 সতীশ। মেসোমশাই, প্রতিকারের আর কোনাে সম্ভাবনা নেই। মাসিমার সঙ্গে আমার এখন যেরূপ সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে তাতে তােমার ঘরের অন্ন আমার গলা দিয়ে আর গলবে না। এতদিন তােমাদের যা খরচ করিয়েছি তা যদি শেষ কড়িটি পর্যন্ত শােধ করে না দিতে পারি, তবে আমার মরেও শান্তি নেই। প্রতিকার যদি কিছু থাকে তাে সে আমার হাতে, তুমি কী প্রতিকার করবে।

 শশধর। না, শােনাে সতীশ, একটু স্থির হও। তােমার যা কর্তব্য সে তুমি পরে ভেবাে—তােমার সম্বন্ধে আমরা যে অন্যায় করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত তাে আমাকেই করতে হবে। দেখাে, আমার বিষয়ের এক অংশ আমি তােমাকে লিখে দেব—সেটাকে তুমি দান মনে কোরাে না, সে তােমার প্রাপ্য। আমি সমস্ত ঠিক করে রেখেছি—পরশু শুক্রবারে রেজেস্ট্রী করে দেব।

 সতীশ। (শশধরের পায়ের ধূলা লইয়া) মেসোমশায়, কী আর বলব—তোমার এই স্নেহে—

 শশধর। আচ্ছা, থাক্ থাক্। ও-সব স্নেহ-ফ্নেহ আমি কিছু বুঝি নে, রসকষ আমার কিছুই নেই—যা কর্তব্য তা কোনাে রকমে পালন করতেই হবে এই বুঝি। সাড়ে আটটা বাজল, তুমি আজ কোরিন্থিয়ানে যাবে বলেছিলে, যাও। সতীশ, একটা কথা তােমাকে বলে রাখি, দানপত্রখানা আমি মিস্টার ভাদুড়িকে দিয়েই লিখিয়ে নিয়েছি। ভাবে বােধ হল, তিনি এই ব্যাপারে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন—তােমার প্রতি যে তাঁর টান নেই এমন তাে দেখা গেল না। এমন-কি, আমি চলে আসবার সময় তিনি আমাকে বললেন, সতীশ আজকাল আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে না কেন।

সতীশের প্রস্থান

 ওরে রামচরণ, তাের মা-ঠাকুরানীকে একবার ডেকে দে তাে।

সুকুমারীর প্রবেশ

 সুকুমারী। কী স্থির করলে।

 শশধর। একটা চমৎকার প্ল্যান ঠাউরেছি।

 সকুমারী। তােমার প্ল্যান যত চমৎকার হবে সে আমি জানি। যা হােক, সতীশকে এ বাড়ি হতে বিদায় করেছ তাে?

 শশধর। তাই যদি না করব তবে আর প্ল্যান কিসের। আমি ঠিক করেছি, সতীশকে আমাদের তরফ-মানিকপর লিখে-পড়ে দেব—তা হলেই সে স্বচ্ছন্দে নিজের খরচ নিজে চালিয়ে আলাদা হয়ে থাকতে পারবে। তোমাকে আর বিরক্ত করবে না।

 সকুমারী। আহা, কী সুন্দর প্ল্যানই ঠাউরেছ। সৌন্দর্যে আমি একেবারে মুগ্ধ। না, না তুমি অমন পাগলামি করতে পারবে না, আমি বলে দিলেম।

 শশধর। দেখো, এক সময়ে তো ওকেই সমস্ত সম্পত্তি দেবার কথা ছিল।

 সুকুমারী। তখন তো আমার হরেন জন্মায় নি। তা ছাড়া তুমি কি ভাব, তোমার আর ছেলেপুলে হবে না।

 শশধর। সুকু, ভেবে দেখো আমাদের অন্যায় হচ্ছে। মনেই কর-না কেন, তোমার দুই ছেলে।

 সুকুমারী। সে আমি অতশত বুঝি নে। তুমি যদি এমন কাজ কর তবে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব, এই আমি বলে গেলেম।

সুকুমারীর প্রস্থান। সতীশের প্রবেশ

 শশধর। কী সতীশ, থিয়েটারে গেলে না?

 সতীশ। না মেসোমশাই, আজ আর থিয়েটার না। এই দেখো, দীর্ঘকাল পরে মিস্টার ভাদুড়ির কাছ হতে আমি নিমন্ত্রণ পেয়েছি। তোমার দানপত্রের ফল দেখো। সংসারের উপর আমার ধিক্কার জন্মে গেছে, মেলোমশায়। আমি তোমার সে তালুক নেব না।  শশধর। কেন, সতীশ।

 সতীশ। আমি ছদ্মবেশে পথিবীর কোনো সুখভোগ করব না। আমার যদি নিজের কোনো মূল্য থাকে, তবে সেই মূল্য দিয়ে যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকুই ভোগ করব, তার চেয়ে এক কানাকড়িও আমি বেশি চাই না। তা ছাড়া, তুমি যে আমাকে তোমার সম্পত্তির অংশ দিতে চাও, মাসিমার সম্মতি নিয়েছ তো?

 শশধর। না, সে তিনি—অর্থাৎ, সে এক রকম করে হবে। হঠাৎ তিনি রাজি না হতে পারেন, কিন্তু—

 সতীশ। তুমি তাঁকে বলেছ?

 শশধর। হাঁ, বলেছি বইকি! বিলক্ষণ! তাঁকে না বলেই কি আর—

 সতীশ। তিনি রাজি হয়েছেন?

 শশধর। তাঁকে ঠিক রাজি বলা যায় না বটে—কিন্তু ভালো করে বুঝিয়ে—

 সতীশ। বৃথা চেষ্টা, মেলোমশায়। তাঁর নারাজিতে তোমার সম্পত্তি নিতে চাই নে। তুমি তাঁকে বোলো, আজ পর্যন্ত তিনি আমাকে যে অন্ন খাইয়েছেন তা উদ্গার না করে আমি বাঁচব না। তাঁর সমস্ত ঋণ সুদসুদ্ধ শোধ করে তবে আমি হাঁফ ছাড়ব।

 শশধর। সে কিছুই দরকার নেই, সতীশ—তোমাকে বরঞ্চ কিছু নগদ টাকা গোপনে—

 সতীশ। না মেলোমশায়, আর ঋণ বাড়াব না। তোমার কাছে এখন কেবল আমার একটি অনুরোেধ আছে। তোমার যে সাহেব-বন্ধুর আপিসে আমাকে কাজ দিতে চেয়েছিলে, সেখানে আমার কাজ জুটিয়ে দিতে হবে।

 শশধর। পারবে তো?

 সতীশ। এর পরেও যদি না পারি তবে পুনর্বার মাসিমার অন্ন খাওয়াই আমার উপযুক্ত শাস্তি হবে।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

 সুকুমারী। দেখাে দেখি, এখন সতীশ কেমন পরিশ্রম করে কাজকর্ম করছে। দেখাে, অতবড় সাহেববাবু, আজকাল পুরানাে কালাে আল্‌পাকার চাপানের উপরে কোঁচানাে চাদর বুলিয়ে কেমন নিয়মিত আপিসে যায়!

 শশধর। বড়ােসাহেব সতীশের খুব প্রশংসা করেন।

 সকুমারী। দেখাে দেখি, তুমি যদি তােমার জমিদারিটা তাকে দিয়ে বসতে তবে এতদিনে সে টাই-কলার-জুতা-ছড়ি কিনেই সেটা নিলামে চড়িয়ে দিত। ভাগ্যে আমার পরামর্শ নিয়েছ, তাই তাে সতীশ মানুষের মতাে হয়েছে।

 শশধর। বিধাতা আমাদের বুদ্ধি দেন নি কিন্তু স্ত্রী দিয়েছেন, আর তােমাদের বুদ্ধি দিয়েছেন তেমনি সঙ্গে সঙ্গে নির্বোধ স্বামীগুলাকেও তােমাদের হাতে সমর্পণ করেছেন আমাদেরই জিত।

 সুকুমারী। আচ্ছা আচ্ছা, ঢের হয়েছে, ঠাট্টা করতে হবে না। কিন্তু, সতীশের পিছনে এতদিন যে টাকাটা ঢেলেছ সে যদি আজ থাকত তবে—

 শশধর। সতীশ তাে বলেছে, কোনাে-একদিন সে সমস্তই শােধ করে দেবে।

 সুকুমারী। সে যত শােধ করবে আমার গায়ে রইল! সে তাে বরাবরই ওইরকম লম্বাচৌড়া কথা বলে থাকে। তুমি বুঝি সেই ভরসায় পথ চেয়ে বসে আছ!

 শশধর। এতদিন তাে ভরসা ছিল, তুমি যদি পরামর্শ দাও তাে সেটা বিসর্জন দিই।

 সুকুমারী। দিলে তােমার বেশি লােকসান হবে না, এই পর্যন্ত বলতে পারি। ওই-যে তােমার সতীশবাবু আসছেন। চাকরি হয়ে অবধি একদিনও তাে আমাদের চৌকাঠ মাড়ান নি, এমনি তাঁর কৃতজ্ঞতা! আমি যাই।

সতীশের প্রবেশ

 সতীশ। মাসিমা, পালাতে হবে না। এই দেখাে, আমার হাতে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই নেই —কেবল খানকয়েক নােট আছে।

 শশধর। ইস! এ যে একতাড়া নােট! যদি আপিসের টাকা হয় তাে এমন করে সঙ্গে নিয়ে বেড়ানাে ভালাে হচ্ছে না, সতীশ।

 সতীশ। আর সঙ্গে নিয়ে বেড়াব না। মাসিমার পায়ে বিসর্জন দিলাম। প্রণাম হই, মাসিমা। বিস্তর অনুগ্রহ করেছিলে—তখন তার হিসাব রাখতে হবে মনেও করি নি, সুতরাং পরিশােধের অঙ্কে কিছু ভুলচুক হতে পারে। এই পনেরাে হাজার টাকা গুনে নাও। তােমার খােকার পােলাও-পরমান্নে একটি তণ্ডুলকণাও কম না পড়ুক।

 শশধর। এ কী কাণ্ড, সতীশ। এত টাকা কোথায় পেলে।

 সতীশ। আমি গুন্‌চট আজ ছয় মাস আগাম খরিদ করে রেখেছি—ইতিমধ্যে দর চড়েছে; তাই মুনফা পেয়েছি।

 শশধর। সতীশ, এ যে জুয়াখেলা!

 সতীশ। খেলা এইখানেই শেষ—আর দরকার হবে না।

 শশধর। তােমার এ টাকা তুমি নিয়ে যাও, আমি চাই না।

 সতীশ। তোমাকে তো দিই নি, মেসোমশায়। এ মাসিমার ঋণশোধ। তোমার ঋণ কোনো কালে শোধ করতে পারব না।

 শশধর। কী সুকু, এ টাকাগুলো—

 সুকুমারী। গুনে খাতাঞ্চির হাতে দাও-না—ওইখানেই কি ছড়ানো পড়ে থাকবে।

 শশধর। সতীশ, খেয়ে এসেছ তো?

 সতীশ। বাড়ি গিয়ে খাব।

 শশধর। অ্যাাঁ, সে কী কথা। বেলা যে বিস্তর হয়েছে। আজ এইখানেই খেয়ে যাও।

 সতীশ। আর খাওয়া নয়, মেসোমশায়। এক দফা শোধ করলেম, অন্ন-ঋণ আবার নতন করে ফাঁদতে পারব না।

প্রস্থান

 সুকুমারী। বাপের হাত হতে রক্ষা করে এতদিন ওকে খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করলেম, আজ হাতে দু-পয়সা আসতেই ভাবখানা দেখেছ! কৃতজ্ঞতা এমনিই বটে! ঘোর কলি কিনা।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

 সতীশ। বড়োসাহেব হিসাবের খাতাপত্র কাল দেখবেন। মনে করেছিলেম, ইতিমধ্যে ‘গানি’র টাকাটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে, তহবিল পুরণ করে রাখব—কিন্তু বাজার নেমে গেল। এখন জেল ছাড়া গতি নেই। ছেলেবেলা হতে সেখানে যাবারই আয়োজন করা গেছে।

 কিন্তু, অদৃষ্টকে ফাঁকি দেব। এই পিস্তলে দুটি গুলি পুরেছি—এই যথেষ্ট। নেলি— না না, ও নাম নয়, ও নাম নয়—আমি তা হলে মরতে পারব না। যদি বা সে আমাকে ভালোবেসে থাকে, সে ভালোবাসা আমি ধূলিসাৎ করে দিয়ে এসেছি। চিঠিতে আমি তার কাছে সমস্তই কবুল করে লিখেছি। এখন পৃথিবীতে আমার কপালে যার ভালোবাসা বাকি রইল সে আমার এই পিস্তল। আমার অন্তিমের প্রেয়সী, ললাটে তোমার চুম্বন নিয়ে চক্ষু মুদব।

 মেসোমশায়ের এ বাগানটি আমারই তৈরি। যেখানে যত দুর্লভ গাছ পাওয়া যায় সব সংগ্রহ করে এনেছিলেম। ভেবেছিলেম, এ বাগান একদিন আমারই হবে। ভাগ্য কার জন্য আমাকে দিয়ে এই গাছগুলো রোপণ করে নিচ্ছিল, তা আমাকে তখন বলে নি—তা হোক্, এই ঝিলের ধারে এই বিলাতি স্টিফানোটিস লতার কুঞ্জে আমার এ জন্মের হাওয়া-খাওয়া শেষ করব—মত্যুর দ্বারা আমি এ বাগান দখল করে নেব—এখানে হাওয়া খেতে আসতে আর কেউ সাহস করবে না।

 মেসোমশায়কে প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিতে চাই। পৃথিবী হতে ওই ধুলোটুকু নিয়ে যেতে পারলে আমার মৃত্যু সার্থক হ’ত। কিন্তু, এখন সন্ধ্যার সময় তিনি মাসিমার কাছে আছেন—আমার এ অবস্থায় মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে আমি সাহস করি নে। বিশেষত পিস্তল ভরা আছে।

 মরবার সময় সকলকে ক্ষমা করে শান্তিতে মরার উপদেশ শাস্ত্রে আছে। কিন্তু, আমি ক্ষমা করতে পারলেম না। আমার এ মরবার সময় নয়। আমার অনেক সুখের কল্পনা, ভোগের আশা ছিল—অল্প কয়েক বৎসরের জীবনে তা একে একে সমস্তই টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙেছে। আমার চেয়ে অনেক অযোগ্য অনেক নির্বোধ লোকের ভাগ্যে অনেক অযাচিত সুখ জুটেছে, আমার জুটেও জুটল না—সেজন্য যারা দায়ী তাদের কিছুতেই ক্ষমা করতে পারব না—কিছুতেই না। আমার মৃত্যুকালের অভিশাপ যেন চিরজীবন তাদের পিছনে পিছনে ফেরে—তাদের সকল সুখকে কানা করে দেয়। তাদের তৃষ্ণার জলকে বাষ্প করে দেবার জন্য আমার দগ্ধ জীবনের সমস্ত দাহকে যেন আমি রেখে যেতে পারি।

 হায়! প্রলাপ! সমস্তই প্রলাপ! অভিশাপের কোনো বলই নেই। আমার মৃত্যু কেবল আমাকেই শেষ করে দেবে—আর-কারও গায়ে হাত দিতে পারবে না। আঃ—তারা আমার জীবনটাকে একেবারে ছারখার করে দিলে, আর আমি মরেও তাদের কিছুই করতে পারলেম না। তাদের কোনো ক্ষতি হবে না— তারা সুখে থাকবে, তাদের দাঁত-মাজা হতে আরম্ভ ক’রে মশারি-ঝাড়া পর্যন্ত কোনো তুচ্ছ কাজটিও বন্ধ থাকবে না—অথচ আমার সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্রের সমস্ত আলোক এক ফুৎকারে নিবল—আমার নেলি—উঃ, ও নাম নয়।

 ও কে ও! হরেন! সন্ধ্যার সময় বাগানে বার হয়েছে যে! বাপ-মাকে লুকিয়ে চুরি করে কাঁচা পেয়ারা পাড়তে এসেছে। ওর আকাঙ্ক্ষা ওই কাঁচা পেয়ারার চেয়ে আর অধিক ঊর্ধ্বে চড়ে নি—ওই গাছের নিচু ডালেই ওর অধিকাংশ সুখ ফলে আছে। পৃথিবীতে ওর জীবনের কী মূল্য। গাছের একটা কাঁচা পেয়ারা যেমন, এ সংসারে ওর কাঁচা জীবনটাই বা তার চেয়ে কী এমন বড়ো। এখনি যদি ছিন্ন করা যায়, তবে জীবনের কত নৈরাশ্য হতে ওকে বাঁচানো যায় তা কে বলতে পারে। আর মাসিমা—ইঃ! একেবারে লুটাপুটি করতে থাকবে। আঃ!

 ঠিক সময়টি, ঠিক স্থানটি, ঠিক লোকটি। হাতকে আর সামলাতে পারছি নে। হাতটাকে নিয়ে কী করি। হাতটাকে নিয়ে কী করা যায়।


 ছড়ি লইয়া সতীশ সবেগে চারাগাছগুলিকে ক্রমাগত আঘাত করিতে লাগিল। তাহাতে তাহার উত্তেজনা ক্রমশ আরও বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে নিজের হাতকে সে সবেগে আঘাত করিল; কিন্তু কোনো বেদনা বোধ করিল না। শেষে পকেটের ভিতর হইতে পিস্তল সংগ্রহ করিয়া লইয়া সে হরেনের দিকে সবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল।

 হরেন। (চমকিয়া উঠিয়া) এ কী। দাদা নাকি। তোমার দুটি পায়ে পড়ি দাদা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি—বাবাকে বলে দিয়ো না।

 সতীশ। (চীৎকার করিয়া) মেসোমশায়—মেসোমশায়—এইবেলা রক্ষা করো— আর দেরি কোরো না—তোমার ছেলেকে এখনো রক্ষা করো।

 শশধর। (ছুটিয়া আসিয়া) কী হয়েছে, সতীশ। কী হয়েছে।

 সুকুমারী। (ছুটিয়া আসিয়া) কী হয়েছে, আমার বাছার কী হয়েছে।

 হরেন। কিছুই হয় নি, মা—কিছুই না—দাদা তোমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।

 সুকুমারী। এ কিরকম বিশ্রী ঠাট্টা। ছি ছি, সকলই অনাসৃষ্টি! দেখাে দেখি। আমার বুকে এখনাে ধড়াস্-ধড়াস্ করছে। সতীশ মদ ধরেছে বুঝি!

 সতীশ। পালাও—তােমার ছেলেকে নিয়ে এখনই পালাও। নইলে তােমাদের রক্ষা নেই।

হরেনকে লইয়া ত্রস্তপদে সুকুমারীর পলায়ন

 শশধর। সতীশ, অমন উতলা হােয়াে না। ব্যাপারটা কী বলো। হরেনকে কার হাত হতে রক্ষা করবার জন্য ডেকেছিলে।

 সতীশ। আমার হাত হতে। (পিস্তল দেখাইয়া) এই দেখাে, মেসােমশায়।

দ্রুতপদে বিধুমুখীর প্রবেশ

 বিধু। সতীশ, তুই কোথায় কী সর্বনাশ করে এসেছিস বল দেখি। আপিসের সাহেব পুলিশ সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে খানাতল্লাসি করতে এসেছে। যদি পালাতে হয় তাে এইবেলা পালা। হায় ভগবান! আমি তাে কোনাে পাপ করি নি, আমারই অদৃষ্টে এত দুঃখ ঘটে কেন।

 সতীশ। ভয় নেই—পালাবার উপায় আমার হাতেই আছে।

 শশধর। তবে কি তুমি—

 সতীশ। তাই বটে মেসােমশায়—যা সন্দেহ করছ তাই। আমি চুরি করে মাসির ঋণ শােধ করেছি। আমি চোর। মা, শুনে খুশি হবে, আমি চোর, আমি খুনী! এখন আর কাঁদতে হবে না—যাও যাও, আমার সম্মুখ হতে যাও। আমার অসহ্য বােধ হচ্ছে।

 শশধর। সতীশ, তুমি আমার কাছেও তাে কিছু ঋণী আছ, তাই শােধ করে যাও।

 সতীশ। বলাে, কেমন করে শােধ করব। কী আমি দিতে পারি। কী চাও তুমি।

 শশধর। ওই পিস্তলটা দাও।

 সতীশ। এই দিলাম। আমি জেলেই যাব। না গেলে আমার পাপের ঋণশােধ হবে না।

 শশধর। পাপের ঋণ শাস্তির দ্বারা শােধ হয় না সতীশ, কর্মের দ্বারাই শােধ হয়। তুমি নিশ্চয় জেনাে, আমি অনুরােধ করলে তােমার বড়ােসাহেব তােমাকে জেলে দেবেন না। এখন হতে জীবনকে সার্থক করে বেঁচে থাকো।

 সতীশ। মেসোমশায়, এখন আমার পক্ষে বাঁচা যে কত কঠিন তা তুমি জান না—মরব নিশ্চয় জেনে পায়ের তলা হতে আমার শেষ সুখের অবলম্বনটা আমি পদাঘাতে ফেলে দিয়ে এসেছি—এখন কী নিয়ে বাঁচব।

 শশধর। তবু বাঁচতে হবে, আমার ঋণের এই শােধ,—আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না।

 সতীশ। তবে তাই হবে।

 শশধর। আমার একটা অনুরােধ শোনো। তােমার মাকে আর মাসিকে অন্তরের সহিত ক্ষমা করাে।

 সতীশ। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা করতে পার, তবে এ সংসারে কে এমন থাকতে পারে যাকে আমি ক্ষমা করতে না পারি।

প্রণাম করিয়া

 মা, আশীর্বাদ করাে আমি সব যেন সহ্য করতে পারি—আমার সকল দোষগুণ নিয়ে তােমরা আমাকে যেমন গ্রহণ করেছ সংসারকে আমি যেন তেমনি করে গ্রহণ করি।

 বিধু। বাবা, কী আর বলব। মা হয়ে আমি তােকে কেবল স্নেহই করেছি, তাের কোনাে ভালাে করতে পারি নি—ভগবান তাের ভালাে করুন। দিদির কাছে আমি একবার তাের হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে নিই গে।

প্রস্থান

 শশধর। তবে এসাে সতীশ, আমার ঘরে আজ আহার করে যেতে হবে।

দ্রুতপদে নলিনীর প্রবেশ

 নলিনী। সতীশ।

 সতীশ। কী, নলিনী।

 নলিনী। এর মানে কী। এ চিঠি তুমি আমাকে কেন লিখেছ।

 সতীশ। মানে যেমন বুঝেছিলে সেইটেই ঠিক। আমি তােমাকে প্রতারণা করে চিঠি লিখি নি। তবে আমার ভাগ্যক্রমে সকলই উল্‌টা হয়। তুমি মনে করতে পার, তােমার দয়া উদ্রেক করবার জন্যই আমি—কিন্তু মেলােমশায় সাক্ষী আছেন, আমি অভিনয় করছিলেম না—তবু যদি বিশ্বাস না হয় প্রতিজ্ঞারক্ষা করবার এখনাে সময় আছে।

 নলিনী। কী তুমি পাগলের মতাে বকছ। আমি তােমার কী অপরাধ করেছি যে তুমি আমাকে এমন নিষ্ঠর ভাবে—

 সতীশ। যেজন্য আমি এই সংকল্প করেছি সে তুমি জান, নলিনী—আমি তাে একবর্ণও গােপন করি নি, তবু কি আমার উপর তােমার শ্রদ্ধা আছে।

 নলিনী। শ্রদ্ধা! সতীশ, তােমার উপর ওইজন্যই আমার রাগ ধরে। শ্রদ্ধা! ছি ছি, শ্রদ্ধা তাে পথিবীতে অনেকেই অনেককে করে। তুমি যে কাজ করেছ আমিও তাই করেছি—তােমাতে আমাতে কোনাে ভেদ রাখি নি। এই দেখাে, আমার গহনাগুলি সব এনেছি—এগুলি এখনাে আমার সম্পত্তি নয়—এগুলি আমার বাপ-মায়ের। আমি তাঁদিগকে না বলে এনেছি, এর কত দাম হতে পারে আমি কিছুই জানি নে; কিন্তু এ দিয়ে কি তােমার উদ্ধার হবে না।

 শশধর। উদ্ধার হবে, এই গহনাগুলির সঙ্গে আরও অমূল্য যে ধনটি দিয়েছ তা দিয়েই সতীশের উদ্ধার হবে।

 নলিনী। এই-যে শশধরবাবু মাপ করবেন, তাড়াতাড়িতে আপনাকে আমি—

 শশধর। মা, সেজন্য লজ্জা কী। দৃষ্টির দোষ কেবল আমাদের মতাে বুড়ােদেরই হয় না—তােমাদের বয়সে আমাদের মতাে প্রবীণ লােক হঠাৎ চোখে ঠেকে না। সতীশ, তােমার আপিসের সাহেব এসেছেন দেখছি। আমি তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে আসি, ততক্ষণ তুমি আমার হয়ে অতিথিসৎকার করাে।—মা, এই পিস্তলটা এখন তােমার জিম্মাতেই থাকতে পারে।

 পৌষ ১৩১০