পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৬

উইকিসংকলন থেকে
শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়
কটক
রবিবার

পরম পূজনীয়
শ্রীমতী মাতাঠাকুরাণী
শ্রীচরণ কমলেষু,
মা,

 ভারতবর্ষ ভগবানের বড় আদরের স্থান—এই মহাদেশে লোক শিক্ষার নিমিত্ত ভগবান্ যুগে ২ অবতাররূপে জন্মগ্রহণ করিয়া পাপক্লিষ্টা ধরণীকে পবিত্র করিয়াছেন এবং প্রত্যেক ভারতবাসীর হৃদয়ে ধর্ম্মের ও সত্যের বীজ রোপণ করিয়া গিয়াছেন। ভগবান্ মানবদেহ ধারণ করিয়া নিজের অংশাবতার রূপে অনেক দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু এতবার তিনি কোনও দেশে জন্মগ্রহণ করেন নাই—তাই বলি আমাদের জন্মভূমি ভারতমাতা ভগবানের বড় আদরের দেশ। দেখ, মা, ভারতে যাহা চাও সবই আছে—প্রচণ্ড গ্রীষ্ম, দারুণ শীত, ভীষণ বৃষ্টি আবার মনোহর শরৎ ও বসন্তকাল, সবই আছে। দাক্ষিণাত্যে দেখি—স্বচ্ছসলিলা, পুণ্যতোয়া গোদাবরী দুই কূল ভরিয়া তর তর কল কল শব্দে নিরন্তর সাগরাভিমুখে চলিয়াছে—কি পবিত্র নদী! দেখিবামাত্র বা ভাবিবামাত্র রামায়ণে পঞ্চবটীর কথা মনে পড়ে— তখন মানসনেত্রে দেখি সেই তিনজন—রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা, সমস্ত রাজ্য ও সম্পদ ত্যাগ করিয়া, সুখে, মহাসুখে, স্বর্গীয় সুখের সহিত গোদাবরী-তীরে কালহরণ করিতেছেন—সাংসারিক দুঃখের বা চিন্তার ছায়া আর তাঁহাদের প্রসন্ন বদনকমলকে মলিন করিতেছে না— প্রকৃতির উপাসনা ও ভগবানের আরাধনা করিয়া তাঁহারা তিনজনে মহা আনন্দে কাল কাটাইতেছেন—আর এদিকে আমরা সাংসারিক দুঃখানলে নিরন্তর পুড়িতেছি। কোথায় সে সুখ, কোথায় সে শান্তি! আমরা শান্তির জন্য হাহাকার করিতেছি! ভগবানের চিন্তন ও পূজন ভিন্ন আর শান্তি নাই। যদি মর্ত্ত্যে কোনও সুখ থাকে তাহা হইলে গৃহে গৃহে গোবিন্দেব নামকীর্ত্তন ভিন্ন আর সুখের উপায় নাই। আবার যখন ঊর্ধ্বে দৃষ্টি তুলি, মা, তখন আরও পবিত্র দৃশ্য দেখি। দেখি—পুণ্য-সলিলা জাহ্নবী সলিলভার বহন করিয়া চলিয়াছে— আবার রামায়ণের আর একঠি দৃশ্য মনে পড়ে। তখন দেখি বাল্মীকির সেই পবিত্র তপোবন— দিবারাত্র মহর্ষির পবিত্র কণ্ঠোদ্ভূত পূত বেদমন্ত্রে শব্দায়িত—দেখি বৃদ্ধ মহর্ষি অজিনাসনে বসিয়া আছেন—তাঁহার পদতলে দুইটি শিষ্য—কুশ ও লব—মহর্ষি তাঁহাদিগকে শিক্ষা দিতেছেন। পবিত্র বেদধ্বনিতে আকৃষ্ট হইয়া ক্রূর সর্পও নিজের বিষ হারাইয়া, ফণা তুলিয়া নীরবে মন্ত্রপাঠ শুনিতেছে—গোকুল গঙ্গায় সলিল পান করিবার জন্য আসিয়াছে—তাহারাও একবার মুখ তুলিয়া সেই পবিত্র মন্ত্রধ্বনি শুনিতেছে—শুনিয়া কর্ণদ্বয় সার্থক করিতেছে। নিকটে হরিণ শুইয়া আছে—সমস্তক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে মহর্ষির মুখপানে চাহিয়া আছে। রামায়ণে সবই পবিত্র—সামান্য তৃণের বর্ণনা পর্য্যন্তও পবিত্র, কিন্তু হায়! সেই পবিত্রতা অমরা ধর্ম্মত্যাগী বলিয়া আর এখন বুঝিতে পারি না। আর একটি পবিত্র দৃশ্য মনে পড়িতেছে। ত্রিভুবনতারিণী কলুষ-হারিণী ভাগীরথী চলিয়াছেন—তাঁহার তীরে যোগিকুল বসিয়া আছেন—কেহ অর্দ্ধনিমীলিত নেত্রে প্রাতঃসন্ধ্যায় নিমগ্ন—কেহ কাননের পুষ্পরাজি তুলিয়া প্রতিমা গড়িয়া, চন্দন ধূপ প্রভৃতি পবিত্র সুগন্ধি দ্রব্য দিয়া পূজা করিতেছেন—কেহ মন্ত্রোচ্চারণে দিগ্‌দিগন্ত মুখরিত করিতেছেন, কেহ গঙ্গায় পবিত্র সলিলে আচমন করিয়া আপনাকে পবিত্র করিতেছেন—কেহ গুন্ গুন্ করিয়া গান করিতে ২ পূজার জন্য বনফুল তুলিতেছেন। সকলই পবিত্র—সকলই নয়ন ও মনের প্রীতিকর। কিন্তু হায়! যখন ভাবি সেই পুণ্যশ্লোক ঋষিকুল কোথায়? তাঁহাদের সেই পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণ কোথায়? তাঁহাদের সেই যাগযজ্ঞ, পূজা হোম প্রভৃতি কোথায়? ভাবিলে হৃদয় বিদীর্ণ হয়! আমাদের ধর্ম্ম নাই, কিছুই নাই—জাতীয় জীবন পর্য্যন্তও নাই। আমরা এখন এক দুর্ব্বল শরীর পরদাসত্ব-ব্যবসায়ী, নষ্টধর্ম্ম, পাপিষ্ঠ জাতি! হায়! পরমেশ্বর! সেই ভারতের এখন কি শোচনীয় অবস্থা উপস্থিত! তুমি কি আমাদের উদ্ধার করবে না? এ ত তোমারই দেশ—কিন্তু দেখ ভগবান্, তোমার দেশের কি অবস্থা! তোমার অবতারগণ যে সনাতন ধর্ম্ম প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন তাহা কোথায়? আমাদের পূর্ব্বপুরুষ আর্য্যগণ যে জাতি এবং যে ধর্ম্ম গঠিত ও প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন তাহা এখন ছারখার হইয়াছে। দয়া কর, রক্ষা কর, ওহে দয়াময় হরি!

 মা, আমি যখন চিঠি লিখিতে বসি তখন পাগলের চেয়েও পাগল। কি লিখিব ভাবিয়া লিখিতে বসি না এবং কি বা লিখিতে পারি তাহ জানি না। মনে যে ভাবটি আগে আসে তাহাই লিপিবদ্ধ করি— ভাবি না কি লিখিতেছি বা কেন লিখিতেছি। ইচ্ছা হয় তাই লিখি—মন বলে—লেখ—তাই লিখি। যদি কিছু অসঙ্গত লিখিয়া থাকি তবে আমাকে মার্জ্জনা করিবেন।

 পূজ্যপাদ স্বর্গীয় গুরুদেব মহাশয়ের স্বর্গপ্রাপ্তির বিষয় যখন ভাবি তখন দুঃখিত হইব কি অনিন্দিত হইব তাহাভাবিয়া উঠিতে পারি না। মনুষ্য যখন এই পৃথিবী হইতে বিদায় গ্রহণ করে, তখন যে কোথায় যায় বা কিরূপ অবস্থা ভোগ করে তাহা আমরা জানি না। তবে চরমদশায় আমাদের জীবাত্মা পরমাত্মার সহিত বিলীন হইয়া যায়—

সেদিন আমাদের পক্ষে মহা আনন্দের দিন—কোনও দুঃখ নাই— কোনও কষ্ট নাই—পুনর্জ্জন্ম কষ্ট আর আমাদের ভোগ করিতে হয় না— তখন আমরা নিত্যানন্দে বিরাজ করি। যখন ভাবি তিনি সেই নিত্যানন্দ ধামে গিয়াছেন—তিনি অমরগণের সহিত এক পংত্তিতে বসিয়া স্বর্গীয় সুধা পান করিতেছেন তখন আর দুঃখিত হইবার কারণ দেখি না। তিনি যখন সেই সদানন্দপুরে গিয়া মহাসুখে আছেন তখন আমরা যদি তাঁহার সুখেই সুখী হই তবে আমাদের শোকগ্রস্ত হইবার কোনও কারণ নাই। দয়াময় ভগবান যাহা করেন জগতের মঙ্গলের জন্যই করেন। আমরা প্রথমে ২ বুঝিতে পারি নাই কারণ তখন ফল ধরে নাই। যখন ফল পাকে তখন আমরা হৃদয়ের ভিতরে বুঝিতে পারি “বাস্তবিক দয়াময় হর যাহা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন।” ভগবান্ যখন তাঁহার উদ্দেশ্য সাধন করিবার জন্য আমাদের নিকট হইতে তাঁহাকে কাড়িয়া লইয়া সিয়াছেন তখন মিছামিছি আমাদের শোকাকুল হওয়া উচিত নহে—কারণ জিনিষ তাঁহারই—তাঁহার ইচ্ছা হইলে অমনি তিনি কাড়িয়া লইবেন — আমাদের তাহাতে অধিকার কি আছে।

 আবার ভগবানের ইচ্ছায় তিনি যদি তাঁহার বিপথগামী ভ্রাতৃবৃন্দকে ধর্ম্মপথ দেখাইবার জন্য এবং পবিত্র সনাতন ধর্ম্মে দীক্ষিত করিবার জন্য পুনরায় মানবদেহ ধারণ করিয়া থাকেন বা শীঘ্রই করিবেন তবে তাহাতেও আমাদের দুঃখিত হওয়া উচিত নহে। কারণ তাহাতে জগতের অশেষ কল্যাণ সাধিত হইবে। যাহাতে জগতের কল্যাণ হইবে, আমরা ত তাহার বিরোধী হইতে পারি না। জগতের মঙ্গলই প্রত্যেক মানুষের পক্ষে মঙ্গলকর। আমরা ভারতবাসী— অতএব ভারতের মঙ্গলই আমাদের মঙ্গল। তিনি যদি পুনরায় জন্ম পরিগ্রহ করিয়া আমাদের ভ্রাতৃকল্প ভারত সন্তানদিগকে ধর্ম্মনিষ্ঠ করিতে পারেন তাহা হইলে আমাদের যারপরনাই আনন্দিত হওয়া উচিত। গীতায় ভগবান স্বয়ং বলিয়াছেন:

“দেহিনোহস্মিন যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি।”

 আমরা সকলে ভাল আছি। তাঁহার হাতেই আছি—তিনি যেরূপ রাখিয়াছেন, সেইরূপই আছি। আমরা সকলে তাঁহার ক্রীড়াপুত্তলী—আমাদের ক্ষমতা কতটুকু—সবই তাঁহার দয়ার উপর নির্ভর করে। আমরা বাগানের মালী—বাগানের মালিক তিনি। আমরা বাগানে কাজ করি কিন্তু বাগানের ফলে আমাদের কোনও অধিকার নাই। আমরা বাগানে কাজ করি বাগানে যাহা ফল উৎপন্ন হয় তাঁহারই চরণে নিবেদন করিয়া দিই। কার্য্যে আমাদের অধিকার আছে— কার্য্য আমাদের কর্ত্তব্য—কিন্তু ফল তাঁহার—আমাদের নয়। তাই ভগবান গীতায় বলিয়াছেন—

“কর্ম্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”

 লিলি এখন কোথায় ও কেমন আছে? জানি না কোথায় আছে তাই পত্র দিলাম না। মামীমা ও বৌদিদিরা কোথায় ও কেমন আছেন? দাদারা কেমন আছেন? অন্যান্য সকলে কেমন আছেন ও আছে? আপনি ও বাবা কেমন আছেন? আপনারা আমার প্রণাম জানিবেন। মেজদাদার খবর কি? ২।৩ মেলে আমি কোনও পত্র পাই নাই। নূতন মামাবাবু কেমন আছেন?

 শুনিলাম ছোট মামীমার বড় অসুখ হইয়াছে। তিনি কেমন আছেন? সারদা কি বলে? ইতি—

আপনারই সেবক 
সুভাষ