ছাড়িয়া আমি বিলাতে গিয়াছিলাম। পাঁচ ছয় মাস লণ্ডনে থাকিতে থাকিতে আমার বিস্তর সাহেবের সঙ্গে আলাপ হইল। আমিও সাহেবদের সঙ্গে থাকিয়া এক-রকম সাহেব হইয়া পড়িলাম। বাল্যকাল হইতেই জামার সাহেব হইবার ইচ্ছা ছিল। কলিকাতায় একবার সাহেব সাজিয়া কয়েকজন বন্ধুকে এরূপ ভয় দেখাইয়াছিলাম যে, সে কথা মনে পড়িলে হাসি পায়। তাহারা আমাকে সে বেশে চিনিতে পারে নাই। তবু তখন পরচুলের দাড়ি গোঁফ করিয়াছিলাম। এখন আমার বেশ গোঁফ দাড়ি উঠিয়াছে এবং বাঙ্গালি ধরণে দাড়ি না রাখিয়া হুইস্কার রাখিয়াছি। রংটা কিছু কাল, তা প্রত্যহ যেরূপ সোপ ব্যবহার করি তাহাতে এরূপ ভরসা আছে, যে দেশে ফিরিয়া যাইলে নগেন্দ্রনাথ সরকার বলিয়া কেহ চিনিতে পারিবে না।
পূর্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি যে, বিস্তর সাহেব ও ভাল ভাল বিবির সহিত আমার আলাপ হইয়াছে; কিন্তু তন্মধ্যে হার্বি নামক একজন ইঞ্জিনিয়ারের সহিত আমার বন্ধুত্ব হইল। হার্বিসাহেব খুব ভাল ইঞ্জিনিয়ার ও বড় ভদ্রলোক; হার্বির রাজসরকারে চাকরি, মাসিক বেতন একশত পাউণ্ড। আমাদের পরস্পরে এরূপ ভাব জন্মিল যে বাঙ্গালি ও ইংরাজে তদ্রূপ হইতে পারে না; দুই ইংরাজেই সম্ভবে। এইরূপে কিছু দিন যায়, এক দিন সম্বাদ আসিল যে, হার্বি সাহেবের খুড়ির কাল হইয়াছে; তিনি নিঃসন্তান হেতু মৃত্যুকালে হার্বির নামে সমস্ত বিষয় উইল করিয়া গিয়াছেন। এই সংবাদ পাইয়া, আমার বন্ধুর আনন্দের সীমা থাকিল না। আর চাকরি করিতে হইবে না; টেবিলের উপর পা তুলিয়া চিরকাল বড়মান্ষি করিতে পারিবেন; এই আনন্দে বন্ধু উন্মত্ত হইলেন। একেবারে চাকরিতে জবাব দিয়া পরদিনেই হার্বি লণ্ডন পরিত্যাগ করিয়া চলিলেন। যাইবার সময় আমাকে বলিয়া গেলেন “দেখ নগেন্দ্র, বোধ হয় তোমার পরীক্ষা শেষ না হইলে তুমি আমার বাটী দেখিতে যাইতে পারিবে না। তার এখনও আট মাস বিলম্ব আছে। যাহা হউক এই সময়ের মধ্যে আমিও এক রকম বাড়ীটি সাজাইতে পারিব। কিন্তু নিশ্চয় করিয়া বল পরীক্ষার শেষে আমার বাটীতে গিয়া দশ পনর দিন থাকিবে ত?” আমি বলিলাম “তার আর আপত্তি কি? কিন্তু জিজ্ঞাসা করি তোমার নিত্য এত পরিশ্রম করা অভ্যাস; এখনত আর কোন কাজই রহিল না; কিরূপে দিন কাটাইবে? উত্তর। “কেন, কাজের ভাবনা কি? পরের জন্য পরিশ্রম করিতে হইবে না বলিয়া কি আর কর্ম্ম নাই? আমি এথন হইতে নিজের বাটীতে কলবল প্রস্তুত করিব; যাওত দেখিতে পাইবে। আর ভাই বসিতে পারি না, শীঘ্রই ট্রেন ছাড়িবে।”