পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৵৹
মৈমনসিংহ-গীতিকা

 ইহার দুই বৎসর পরে, হঠাৎ একদিন কেদারবাবুর চিঠি পাইলাম। তিনি লিখিলেন,——চন্দ্রকুমার অনেকটা ভাল হইয়াছেন এবং শীঘ্র কলিকাতায় আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করিবেন। তাঁহার আরও চিকিৎসার দরকার।

 স্ত্রীর দুই-একখানি রৌপ্যের অলঙ্কার ছিল, তাহাই বিক্রয় করিয়া চন্দ্রকুমার পাথেয় সংগ্রহ করিলেন; এবং ১৯১৯ সনে পূজার কিছু পূর্ব্বে বেহালায় আসিয়া আমাকে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলেন। রোগে-দুঃখে জীর্ণ,——মুখ পাণ্ডুরবর্ণ,——অৰ্দ্ধাশনে-অনশনে বিশীর্ণ, ত্রিশ বৎসর বয়স্ক যুবক, অতি অল্পভাষী; তিনি পল্লীজীবনের যে কাহিনী শুনাইলেন ও মৈমনসিংহের অনাবিষ্কৃত পল্লীগাথার যে সন্ধান আমাকে দিলেন, তাহাতে তখনই তাঁহাকে আমার প্রিয় হইতে প্রিয়তর বলিয়া মনে হইল।

 এখানে শ্রীযুক্ত যামিনীভূষণ রায় কবিরাজ মহাশয় বিনামূল্যে তাঁহার চিকিৎসার ভার লইলেন, এবং শ্রীযুক্ত গোপালদাস চৌধুরী মহাশয় কতকদিনের জন্য তাঁহাকে নিজ বাটীতে আশ্রয় দিলেন। আমি তাহার সংগৃহীত পল্লীগাথা সম্বন্ধে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে বলিয়া একটা ব্যবস্থা করিবার চেষ্টা করিব, তাঁহাকে এই ভরসা দিলাম।

 চন্দ্রকুমার এইভাবে কতকদিন এখানে কাটাইয়া দেশে চলিয়া গেলেন। কি কষ্টে যে এই সকল পল্লীগাথা তিনি সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহা তিনি ও তাঁহার ভগবান্‌ই জানেন এবং কতক আমি জানিয়াছি। এই সকল গান অধিকাংশ চাষাদের রচনা। এইগুলির অনেক পালা কখনই লিপিবদ্ধ হয় নাই। পূর্ব্বে যেমন প্রতি বঙ্গপল্লীতে কুন্দ ও গন্ধরাজ ফুটিত, বিল ও পুষ্করিণীতে পদ্ম ও কুমুদের কুঁড়ি বায়ুর সঙ্গে তাল রাখিয়া দুলিত——এই সকল গানও তেমনই লোকের ঘরে ঘরে নিরবধি শোনা যাইত, ও তাহাদের তানে সরল কৃষকপ্রাণ তন্ময় হইয়া যাইত। ফুলের বাগানে ভ্রমরের মত এই গানগুলিরও শ্রোতার অভাব হইত না। কিন্তু লোকের রুচি এই দিকে এখন আর নাই। এইগুলি গাহিবার লোকেরও অভাব হইয়াছে, যেহেতু এই শ্রেণীর গানের উপর শ্রোতার সেই কৌতুকপূর্ণ অনুরাগ ফুরাইয়া আসিয়াছে। যাহা লিখিত হয় নাই, আবৃত্তিই যাহা রক্ষার একমাত্র উপায়, অভ্যাস না থাকিলে সেই কাব্যকথার স্মৃতি মলিন হইয়া পড়িবেই। এখন একটি পালাগান সংগ্রহ করিতে হইলে বহু লোকের দরবার করিতে হয়। কাহারও একটি গান মনে আছে কাহারও বা দুইটি,——নানা গ্রামে পর্য্যটন করিয়া নানা লোকের শরণাপন্ন হইয়া একটি সম্পণ পালার উদ্ধার করিতে পারা যায়। এইজন্য চন্দ্রকুমার প্রতি পালাটি সংগ্রহ করিতে গিয়া অনেক কষ্ট সহিয়াছেন।

 প্রথমত: চন্দ্রকুমার মৈমনসিংহ জেলার কবিগণের লিখিত বিশুদ্ধ কাব্যগুলির প্রতি বেশী মনোযোগী হইয়াছিলেন। মুক্তারামের ‘দুগ‌া পুরাণ’, রামকান্তের ‘মনসার ভাসান’,——‘উমার বিবাহ’, ‘শিবদুগ‌ার কোন্দল’, ‘দুর্ব্বাসার পারণ’, ‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ’ এবং ‘নরমেধ-