পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৶৹

যজ্ঞ’ প্রভৃতি বিষয়ক কবিসংগীতগুলি পাছে নষ্ট হইয়া যায়, এই আশঙ্কা করিয়া তিনি আমাকে পুনঃ পুনঃ পত্র লিখিয়াছেন। এইরূপ পুস্তকের উপরই তাঁহার বেশী ঝোঁক ছিল। যদিও পল্লীর ছড়াগুলিকে ইনি অন্তরের ভালবাসা দিয়াছিলেন, তথাপি সংস্কৃত শব্দবহুল কাব্যগুলির পার্শ্বে সেগুলি সময়ে সময়ে তাঁহার চক্ষে ম্লান বোধ হইত, এজন্য সেই পাড়াগেঁয়ে জিনিষগুলিকে বুকে তুলিয়া আদর করিতে তিনি মাঝে মাঝে ভয় পাইতেন, পাছে সাহিত্যের আসরে সভ্যগণ তাঁহাকে জাতিচ্যুত করিয়া বসেন। বানিয়াচঙ্গ, জঙ্গলবাড়ী, রোয়াইলবাড়ী প্রভৃতি নানা স্থানের ছড়াগুলির সংগ্রহ সম্বন্ধে তিনি একবার আমাকে লিখিয়াছিলেন, “এগুলি এত প্রাচীন ও ইহাদের ভাষা এমন পাড়াগেঁয়ে যে শুনিলে হাসি পায় . . . . পয়ারের শেষ ভাগে প্রায়ই মিল নাই। এগুলি সংগ্রহ করিব কি?” অন্য একবার গ্রাম্য ভাষার কিছু নমনা দিয়া লিখিয়াছিলেন “এই ভাষার সংগ্রহ করিব কি না আমাকে সত্বর লিখিয়া জানাইবেন।” কিন্তু তিনি আমাকে পুনঃ পুনঃ মৈমনসিংহ-প্রচলিত রাধাকৃষ্ণ এবং উমা-মেনকাসম্বন্ধীয় কবিগানের প্রাচুর্য্যের ব্যাখ্যা করা সত্ত্বেও তাঁহার এই উৎসাহ আমি খুব সতেজ হইতে দেই নাই। সেই যে অবজ্ঞাত ‘অশিষ্ট’ ভাষায় অনাড়ম্বর সরলতায় পল্লীলক্ষ্মীর প্রাণটি ধরা দিয়াছে, সেই ছড়াগুলির উপরই আমার লোলুপ দৃষ্টি ছিল। যেহেতু কৃত্রিম ভাষার সোনার পিঞ্জরে তোতা পাখীর স্থান হইতে পারে, কিন্তু বৃষ্টিবাদলে আকাশের মুক্ত আঙ্গিনায়ই কোকিলের পঞ্চম স্বর পৃথিবী ছাপাইয়া উঠে।

 ‘সৌরভ’-সম্পাদক শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মজুমদার মহাশয়ের উৎসাহে চন্দ্রকুমারবাবু বিচিত্রভাবে নানা দিক্ দিয়া সাহিত্যিক চেষ্টায় উদ্যোগী হইয়াছিলেন। ‘সৌরভে’ তিনি নানা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখিতে প্রবৃত্ত হন। এ সম্বন্ধে তিনি আমাকে লিখিয়াছিলেন, “চন্দ্রাবতীর উপাখ্যান রচনা করিতে আরম্ভ করিলাম। ‘সৌরভে’ চন্দ্রাবতীর উপাখ্যান আমার প্রথম উদ্যম। ইহার পরে ‘লোহার মাঞ্জাস’ নামে একখানি কাব্য লিখিতে আরম্ভ করি। বলা বাহুল্য, ইহা চাঁদ সদাগর এবং বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের কাহিনী। ইহার সপ্তম সগ পর্য্যন্ত লেখা আছে। শেষ করিতে পারি নাই। সেই সময়ে শরীরের দিকে দৃক্‌পাত না করিয়া গুরুতর পরিশ্রম করিতাম। প্রাতে পত্রিকার জন্য গল্প, বিকালে উপন্যাস ও গভীর রাত্রে ‘লোহার মাঞ্জাস’ লিখিতাম।”

 কেদারবাবু নানা দিক্ দিয়া ইঁহার সাহিত্যিক চেষ্টার উৎসাহ দিতেছিলেন। কিন্তু ‘সৌরভে’ চন্দ্রকুমারবাবুর প্রবন্ধে প্রাচীন পালাগানের যে সামান্য কিছু নমুনা প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহা পড়িয়া আমি কেদারবাবুকে সেইগুলি সংগ্রহের জন্যই প্রবন্ধলেখককে বিশেষভাবে উৎসাহিত করিতে অনুরোধ করিয়া চিঠি লিখিয়াছিলাম। কবিকঙ্কের ‘বিদ্যাসুন্দর’ অপেক্ষা কবিকঙ্কের সম্বন্ধে কবিচতুষ্টয়-বিরচিত পালাটিই আমার নিকট বিশেষ মূল্যবান্ বলিয়া