পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৷৹
মৈমনসিংহ-গীতিকা

বোধ হইয়াছিল। চন্ন্দ্রকুমারবাবুর স্বরচিত ‘চন্দ্রাবতী’র উপাখ্যান অপেক্ষা নয়ানচাঁদ-বিরচিত ‘জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতী’র পালাটি জানিবার জন্যই আমি বিশেষরূপ লালায়িত হইয়াছিলাম। যাহা হউক, ‘সৌরভে’ সেই সকল পালাগানের কিছু কিছু নমুনা প্রকাশিত না হইলে তৎপ্রতি কাহারও দৃষ্টি আকৃষ্ট হইত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্রবে আসার পর আমি চন্দ্রকুমারবাবুকে তাঁহার অন্যান্য সর্ব্ববিধ সাহিত্যিক প্রচেষ্টা হইতে বিরত করিয়া শুধু পালাগান সংগ্রহে মনোযোগী হইতে উপদেশ দেই।

 পৌরাণিক উপাখ্যান-বিষয়ক কাব্যকথা তো প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে ঝুড়ি ঝুড়ি পাওয়া যাইতেছে। বিজয় গুপ্ত, নারায়ণ দেব, বংশীদাস ও কেতকাদাসের ‘মনসামঙ্গলে’র পরে রামকান্তের একখানি ‘পদ্মাপুরাণ’ না পাওয়া গেলেও বঙ্গসাহিত্য বিশেষ শ্রীহীন হইবে না; ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের পরে কবিকঙ্কের ‘বিদ্যাসুন্দর’ না পাওয়া গেলেই বা বিশেষ ক্ষতি কি? ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে ইহাদের অবশ্যই কিছু মূল্য আছে। কিন্তু ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’ বঙ্গের অন্যত্র কোথায় পাইব? ‘দেওয়ানা মদিনা’ ‘ফিরোজ খাঁ’ প্রভৃতির পালা যে বঙ্গসাহিত্যের একটা নূতন দিকের উপর আলোকপাত করিতেছে—এই অপূর্ব্ব জিনিষ বঙ্গসাহিত্যে সুদুর্ল্লভ। বঙ্গসাহিত্য পৌরাণিক উপাখ্যানগুলিতে সংস্কৃত শব্দের সোনালী চুম্‌কি দেওয়া বেনারশী চেলী পরিয়া ঝলমল করিতেছে—কিন্তু পাড়াগাঁয়ের এই সকল সরল কথা, যাহাতে সংস্কৃতের একটুকুও ধারকরা শোভা নাই, যাহা নিজ স্বাভাবিক রূপে অপূর্ব সুন্দর,—তাহার নমুনা আমরা কোথায় পাইতাম! নানা দিক্ দিয়া এই সকল পল্লীগাথায় খাঁটি বাঙ্গালী জীবনের অফুরন্ত সুধা, অচিন্তিতপূর্ব মাধুর্য্য ঝরিয়া পড়িতেছে। ইহা স্বৰ্গ হইতে আহৃত অমৃতভাণ্ড নহে, ইহা আমাদের দেশের আমগাছের মৌচাক, এজন্য এই খাঁটি মধুর আস্বাদ আমাদের নিকট এত ভাল লাগিয়াছে। চন্দ্রকুমার বঙ্গসাহিত্যের নিজ ভাঁড়ার ঘরের সন্ধান দিয়াছেন,—উহা হোটেলের মসলা-দেওয়া মুখরোচক বিলাসখাদ্য-সম্ভার নহে, উহা আমাদের পল্লী-অন্নপূর্ণার শ্রীকরকমলের দান—জীবনদায়ী অন্নব্যঞ্জন। এগুলি জানিতাম না বলিয়া আমরা এতকাল শুধু সীতা-সাবিত্রীকে লইয়া গৌরব করিয়াছি এখন আমরা মলুয়া, মদিনা ও কমলাকে লইয়া তদপেক্ষা বেশী গৌরব করিতে পারিব যেহেতু তাহারা ঘাগরা-পরা বিদেশিনী নহে, শাড়ী-পরা আমাদেরই ঘরের মেয়ে।

 চন্দ্রকুমার জীবনে কতটা দুঃখ, দারিদ্র্য ও দৈন্যের সঙ্গে সংগ্রাম করিয়া সাহিত্যচর্চ্চা করিতেছেন তাহা শুনিলে কষ্ট হয়। নিম্নে তাঁহার জীবন সম্বন্ধে দুই একটি-কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করিতেছি।

 চন্দ্রকুমার ১৮৮৯ খৃ: অব্দে মৈমনসিংহে নেত্রকোণার অন্তর্গত আইথর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি গ্রাম্য পাঠশালায় সামান্যরূপ শিক্ষালাভ করিয়া এক টাকা মাসিক