পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

邻欧3丐 VS সংগত কারণ তাকে বুঝিয়ে না দেওয়া যায়। সে খাবার সময় ভালো কাপড় পরে না পাছে সকড়ি হয় ; সে ছায়া সম্বন্ধেও বিচার করতে শিখেছে। সে যেমন পালকির ভিতরে বসেই গঙ্গাস্নান করে, তেমনি অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে আবৃত থেকে সংসারে চলে ফেরে। বিধি-বিধানের পরে আমারও মায়ের যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু তার চেয়ে আরো বেশি শ্রদ্ধা যে আর-কারও থাকবে এবং তাই নিয়ে সে মনে মনে গুমার করবে, এটা তিনি সইতে পারতেন না । এইজন্যে আমি যখন তাকে বললুম “মা, এ মেয়ের যোগ্যপাত্র আমি নই”, তিনি হেসে বললেন, “না, কলিযুগে তেমন পাত্র মেলা ভার !” আমি বললুম, “তা হলে আমি বিদায় নিই।” মা বললেন, “সে কি, সুনু, তোর পছন্দ হল না ? কেন, মেয়েটিকে তো দেখতে ভালো ।” আমি বললুম, “মা, স্ত্রী তো কেবল চেয়ে চেয়ে দেখবার জন্যে নয়, তার বুদ্ধি থাকাও চাই ।” মা বললেন, “শোনো একবার । এরই মধ্যে তুই তার কম বুদ্ধির পরিচয় কী পেলি ।” আমি বললুম, “বুদ্ধি থাকলে মানুষ দিনরাত এই সব অনৰ্থক অকাজের মধ্যে বঁাচতেই পারে না । হঁাপিয়ে মরে যায় ।” মায়ের মুখ শুকিয়ে গেল । তিনি জানেন, এই বিবাহ সম্বন্ধে বাবা অপর পক্ষে প্রায় পাকা কথা দিয়েছেন । তিনি আরো জানেন যে, বাবা এটা প্রায়ই ভুলে যান যে, অন্য মানুষেরও ইচ্ছে বলে একটা বালাই থাকতে পারে । বস্তুত, বাবা যদি অত্যন্ত বেশি রাগারগি, জবরদস্তি না করতেন তা হলে হয়তো কালক্রমে ঐ পৌরাণিক পুতুলকে বিবাহ করে আমিও একদিন প্রবল রেখে স্নান আহ্নিক এবং ব্ৰত-উপবাস করতে করতে গঙ্গাতীরে সদগতি লাভ করতে পারতুম। অর্থাৎ, মায়ের উপর যদি এই বিবাহ দেবার ভার থাকত তা হলে তিনি সময় নিয়ে, অতি ধীর মন্দ সুযোগে ক্ষণে ক্ষণে কানে মন্ত্র দিয়ে, ক্ষণে ক্ষণে অশ্রষ্টপাত ক’রে কাজ উদ্ধার করে নিতে পারতেন । বাবা যখন কেবলই তর্জন গর্জন করতে লাগলেন আমি তঁাকে মরিয়া হয়ে বললুম, “ছেলেবেলা থেকে খেতে-শুতে চলতে-ফিরতে আমাকে আত্মনির্ভরতার উপদেশ দিয়েছেন, কেবল বিবাহের বেলাতেই কি আত্মনির্ভর চলবে না ।” করেছে, এ আমি দেখি নি । সংগত যুক্তি কুতর্কের আগুনে কখনো জলের মতো কাজ করে না, বরঞ্চ তেলের মতোই কাজ করে থাকে । বাবা ভেবে রেখেছেন তিনি অন্য পক্ষকে কথা দিয়েছেন, বিবাহের ঔচিত্য সম্বন্ধে এর চেয়ে বড়ো প্রমাণ আর কিছুই নেই। অথচ আমি যদি তাকে স্মরণ করিয়ে দিতুম যে, পণ্ডিতমশায়কে মাও একদিন কথা দিয়েছিলেন তবু সে কথায় শুধু যে আমার বিবাহ ফেসে গেল তা নয়, পণ্ডিতমশায়ের জীবিকাও তার সঙ্গে সহমরণে গেলে- তা হলে এই উপলক্ষে একটা ফৌজদারি বাধত । বুদ্ধি বিচার এবং রুচির চেয়ে শুচিতা মন্ত্রতন্ত্র ক্রিয়াকর্ম যে ঢের ভালো, তার কবিত্ব যে সুগভীর ও সুন্দর, তার নিষ্ঠা যে অতি মহৎ, তার ফল যে অতি উত্তম, সিম্বলিজমটাই যে আইডিয়ালিজম, এ কথা বাবা আজকাল আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সময়ে অসময়ে আলোচনা করেছেন । আমি রসনাকে থামিয়ে রেখেছি কিন্তু মনকে তো চুপ করিয়ে রাখতে পারি নি। যে-কথাটা মুখের আগার কাছে এসে ফিরে যেত সেটা হচ্ছে এই যে, “এ-সব। যদি আপনি মানেন তবে পালবার বেলায় মুরগি পালেন কেন ।’ আরো একটা কথা মনে আসত ; বাবাই একদিন দিনক্ষণ পালপার্বণ বিধিনিষেধ দান,দক্ষিণা নিয়ে তার অসুবিধা বা ক্ষতি ঘটলে মাকে কঠোর ভাষায় এ-সব অনুষ্ঠানের পণ্ডিতা নিয়ে তাড়না করেছেন। মা তখন দীনতা স্বীকার করে অবলাজাতি স্বভাবতই অবুঝ বলে মাথা হেঁট ক’রে বিরক্তির ধাকাটা কাটিয়ে দিয়ে ব্ৰাহ্মণভোজনের বিস্তারিত আয়োজনে প্ৰবৃত্ত হয়েছেন। কিন্তু বিশ্বকৰ্মা লজিকের পাকা ছাচে ঢালাই করে জীব সৃজন করেন নি। অতএব কোনো মানুষের কথায় বা কাজে সংগতি নেই। এ কথা বলে তাকে বাগিয়ে নেওয়া যায় না, রাগিয়ে দেওয়া হয় মাত্র । ন্যায়শান্ত্রের দোহাই পাড়লে অন্যায়ের প্রচণ্ডতা বেড়ে ওঠে- যারা পোলিটিকাল বা গাৰ্হস্থ্য অ্যাজিটেশনে শ্রদ্ধাবান তাদের এ কথাটা মনে রাখা উচিত । ঘোড়া যখন তার পিছনের গাড়িটাকে অন্যায় মনে করে তার উপরে লাথি চালায় তখন অন্যায়টা তো থেকেই যায়, মাঝের থেকে তার