শকুন্তলা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৫৪)/ষষ্ঠ অঙ্ক

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ অঙ্ক


নদীতে স্নান করিবার সময় রাজদত্ত অঙ্গুরীয় শকুন্তলার অঞ্চল হইতে সলিলে ভ্রষ্ট হইয়াছিল। ভ্রষ্ট হইবামাত্র এক অতি বৃহৎ রোহিত মৎস্য গ্রাস করিয়া ফেলে। সেই মৎস্য কয়েক দিবস পরে এক ধীবরের জালে পতিত হয়। ধীবর, খণ্ড খণ্ড বিক্রয় করিবার মানসে ঐ মৎস্যকে নানা খণ্ডে বিভক্ত করিয়া, তদীয় উদর মধ্যে অঙ্গুরীয় প্রাপ্ত হইল। অঙ্গুরীয় পাইয়া, পরম উল্লাসিত মনে, এক মণিকারের আপণে বিক্রয় করিতে গেল। মণিকার, সেই মণিময় অঙ্গুরীয় রাজনামাঙ্কিত দেখিয়া, ধীবরকে চোর নিশ্চয় করিয়া নগরপালকে সংবাদ দিল। নগরপাল আসিয়া ধীবরকে পিছমোড়া করিয়া বাধিল এবং জিজ্ঞাসিল অরে বেটা চোর। তুই এই অঙ্গুরীয় কোথায় পাইলি, বল। ধীবর, কহিল মহাশয়! আমি চোর নহি। তখন নগরপাল কহিল তুই বেটা যদি চোর নহিস্, এ অঙ্গুরীয় কেমন করিয়া পাইলি। যদি চুরি করিস্ নাই,রাজা কি সুব্রাহ্মণ দেখিয়া তোকে দান করিয়াছেন।

 এই বলিয়া নগরপাল চৌকীদারকে হুকুম দিলে, চৌকীদার তাহাকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিল। ধীবর কহিল অরে চৌকীদার! আমি চোর নহি, আমাকে মার কেন। আমি কেমন করিয়া এই আঙ্গটী পাইলাম বলিতেছি। এই বলিয়া কহিল আমি ধীবরজাতি, মাছ ধরিয়া বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করি। নগরপাল শুনিয়া কোপাবিষ্ট হইয়া কহিল মর বেটা, আমি তোর জাতি কুল জিজ্ঞাসিতেছি না কি। এই অঙ্গুরীয় কেমন করিয়া তোর হাতে আসিল, বল। ধীবর কহিল আজি সকালে আমি শচীতীর্থে জাল ফেলিয়াছিলাম। একটা বড় রুই মাছ আমার জালে পড়ে। খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া দেখিলাম তাহার উদর মধ্যে এই আঙ্গটী ছিল। তার পর এই দোকানে আসিয়া দেখাইতেছি এমত সময়ে আপনি আসিয়া আমাকে ধরিলেন। আমি আর কিছুই জানি না আমাকে মারিতে হয় মারুন, কাটিতে হয় কাটুন; আমি চুরী করি নাই।

 নগরপাল শুনিয়া আঘ্রাণ লইয়া দেখিল অঙ্গরীয়ে আমিষ গন্ধ নির্গত হইতেছে। তখন সে সন্দিহান হইয়া, চৌকীদারকে কহিল তুই এ বেটাকে এই খানে সাবধানে বসাইয়া রাখ। আমি রাজবাটীতে গিয়া এই সকল বৃত্তান্ত রাজার গোচর করি। রাজা সকল শুনিয়া যেমন অনুমতি করেন। এই বলিয়া নগরপাল অঙ্গুরীয় লইয়া রাজভবনে গমন করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে প্রত্যাগত হইয়। চৌকীদারকে কহিল অরে! ত্বরায় ধীবরের বন্ধন খুলিয়া দে। এ চোর নয়। অঙ্গুরীয় প্রাপ্তি বিষয়ে যাহা কহিয়াছে তাহার কিছুই মিথ্য নহে। আর রাজা উহাকে অঙ্গুরীয়মূল্যের অনুৰূপ এই মহামুল্য পুরস্কার দিয়াছেন। এই বলিয়া পুরস্কার দিয়া ধীবরকে বিদায় করিল এবং চৌকীদারকে সঙ্গে লইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিল।

 এ দিকে, অঙ্গুরীয় হন্তে পতিত হইবামাত্র, শকুন্তলাবৃত্তান্ত আদ্যোপাস্তু রাজার স্মৃতিপথে আৰূঢ় হইল। তখন তিনি, নিতান্ত কাতর হইয়া, যৎপরোনাস্তি বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন; এবং শকুন্তলার পুনর্দ্দর্শন বিষয়ে একান্ত হতাশ্বাস হইয়া সর্ব্ব বিষয়ে নিতান্ত নিরুৎসাহ হইলেন। আহার, বিহার ও রাজকার্য্যপর্য্যালোচনা একবারেই পরিত্যক্ত হইল। শকুন্তলার চিন্তায় একান্ত মগ্ন হইয়া সর্ব্বদাই ম্লানবদনে কাল যাপন করেন। কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না। . কাহাকেও নিকটে আসিতে দেন না। কেবল প্রিয়বয়স্য মাধব্য সর্ব্বদ সমীপে উপবিষ্ট থাকেন। তিনি সান্তনা বাক্যে প্রবোধ দিতে আরম্ভ করিলে, তাঁহার শোকসাগর উথলিয়া উঠিত; নয়নযুগল হইতে অনবরত বাষ্পবারি বিগলিত হইতে থাকিত।

 এক দিবস, রাজার চিত্তবিনোদনার্থে মাধব্য তাঁহাকে প্রমদবনে লইয়া গেলেন। উভয়ে সুশীতল শিলাতলে উপবিষ্ট হইলে, মাধব্য জিজ্ঞাসা করিলেন ভাল বয়স্য। যদি তুমি তপোবনে যথার্থই শকুন্তলার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলে, তবে তিনি উপস্থিত হইলে প্রত্যাখ্যান করিলে কেন। রাজা শুনিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন বয়স্য! ও কথা আর কেন জিজ্ঞাস কর। আমি রাজধানী প্রত্যাগমন করিয়া শকুন্তলাবৃত্তান্ত একবারে বিস্মৃত হইয়াছিলাম। কেন বিস্মৃত হইলাম কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। সে দিবস প্রিয়া কত প্রকারে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু আমার কেমন মতিচ্ছন্ন ঘটিয়াছিল কিছুই স্মরণ হইল না। তাঁহাকে স্বেচ্ছাচারিণী মনে করিয়া, কতই দুর্ব্বাক্য কছিয়াছি,কতই অপমান করিয়াছি। এই বলিতে বলিতে নয়নযুগল অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হইয়া আসিল; বাকশক্তিরহিতের ন্যায় হইয়া কিয়ৎ ক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। অনন্তর মাধব্যকে কহিলেন ভাল, আমিই যেন বিস্মৃত হইয়াছিলাম, তোমাকে ত সমুদায় কহিয়াছিলাম; তুমি কেন কথা প্রসঙ্গে কোন দিন শকুন্তলার কথা উত্থাপন কর নাই। তুমিও কি আমার মত বিস্মৃত হইয়াছিলে।

 তখন মাধব্য কহিলেন বয়স্য! আমার দোষ নাই; তুমি সমুদায় কহিয়া পরিশেষে কহিয়াছিলে শকুন্তলা সংক্রান্ত যে সকল কথা কহিলাম সমস্তই পরিহাসমাত্র, বাস্তবিক নহে। আমিও নিতান্ত নির্ব্বোধ, তোমার শেষ কথাই সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছিলাম। এই নিমিত্ত আর সে কথা উত্থাপন করি নাই। প্রত্যাখ্যান দিবসে আমি তোমার নিকটে ছিলাম না। থাকিলেও বরং, যাহা শুনিয়াছিলাম, বলিতাম। রাজা, দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া, বাষ্পাকুল লোচনে গদগদ বচনে কহিলেন বয়স্য! কার দোষ দিব, সকলই আমার অদৃষ্টের দোষ। এই বলিয়া অত্যন্ত শোকাকুল হইলেন। তখন মাধব্য কহিলেন বয়স্য! এৰূপ শোকে অভিভূত হওয়া তোমার উচিত নহে। দেখ, সৎপুরুষেরা শোক মোহের বশীভূত হয়েন না। প্রাকৃত জনেরাই শোক মোহে বিচেতন হইয়া থাকে। যদি উভয়েই বাযুভরে বিচলিত হয় তবে বৃক্ষে ও পর্ব্বতে বিশেষ কি! তুমি অতি গম্ভীরস্বভাব; ধৈর্য্য অবলম্বন করিয়া শোকাবেগ সংবরণ কর।

 প্রিয়বয়স্যের প্রবোধ বাক্য শ্রবণ করিয়া রাজা কহিলেন সখে আমি নিতান্ত অবোধ নহি; কিন্তু আমার মন কোন ক্রমেই প্রবোধ মানে না। কি বলিয়াই বা প্রবোধ দিব। প্রত্যাখ্যানের পর, প্রিয়া প্রস্থান কালে, সাতিশয় কাতরতা প্রদর্শন পূর্বক, আমার দিকে যে বারংবার বাস্পপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিয়াছিলেন, সেই কাতর দৃষ্টিপাত আমার হৃদয়ে বিষলিপ্ত শল্যের ন্যায় বিদ্ধ হইয়। আছে। আমি সেই সময়ে তাহার প্রতি যে ক্রুরের ব্যবহার করিয়াছি তাহা মনে করিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে। মরিলেও আমার এ দুঃখ বিমোচন হইবেক না।

 মাধব্য রাজাকে নিতান্ত কাতর দেখিয়া আশ্বাস প্রদানর্থ কহিলেন বয়স্য! অত কাতর হইও না; কিছু দিন পরে পুনর্ব্বার শকুন্তলার সহিত সমাগম হইবেক। রাজা কহিলেন বয়স্য! আমি এক মুহুর্তের নিমিত্তেও সে আশা করি না! আর আমি প্রিয়ার দর্শন পাইব না। এ জন্মের মত আমার সকল মুখ ফুরাইয়া গিয়াছে। নতুবা, তৎকালে আমার তেমন দুর্ব্বুদ্ধি ঘটিল কেন। মাধব্য কহিলেন বয়স্থ্য! কোন বিষয়েই এত নিরাশ হওয়া উচিত নয়। ভবিতব্যের কথা কে বলতে পারে। দেখ, এই অঙ্গুরীয় যে পুনরায় তোমার হন্তে আসিবে,কাহার মনে ছিল।  ইহা শুনিয়া অঙ্গুরীয়ে দৃষ্টিপাত করিয়া রাজা উহাকে সচেতন বোধে সম্বোধন করিয়। কহিলেন অঙ্গুরীয়! তুমিও আমার মতো হতভাগা,নতুবা কি নিমিত্ত, প্রিয়ার অঙ্গুলীতে স্থান পাইয়া, পুনর্ব্বার সেই দুর্ল্ভ স্থান হইতে ভ্রষ্ট হইলে। মাধব্য কহিলেন বয়স্য! তুমি কি উপলক্ষে তাহার অঙ্গুলীতে অঙ্গুরীয় পরাইয়া দিয়াছিল। রাজা কহিলেন রাজধানী প্রতিগমন কালে, প্রিয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে আমার হস্ত ধরিয়া কহিলেন আর্য্যপুত্র! কতদিনে আমাকে নিকটে লইয়া যাইবে। তখন আমি এই অঙ্গুরীয় তাহার কোমল অঙ্গলীতে পরাইয়া দিয়া কহিলাম প্রিয়ে! তুমি প্রতি দিন আমার নামের এক একটী অক্ষর গণিবে গণনা সমাপ্ত না হইতে হইতেই আমার লোক আসিয়া তোমাকে লইয়া যাইবে। প্রিয়ার নিকট সরল হৃদয়ে এই প্রতিজ্ঞা করিয়া আসিয়াছিলাম। কিন্তু মোহান্ধ হইয়া একবারেই বিস্মৃত হইয়া যাই।

 তখন মাধব্য কহিলেন ভাল বয়স্য! এ অঙ্গুরীয় কেমন করিয়া রোহিত মৎস্যর উদরে প্রবিষ্ট হইল। রাজা কহিলেন শুনিয়াছি শুচীতীর্থে স্নান করিবার সময় প্রিয়ার অঞ্চলপ্রান্ত হইতে সলিলে ভ্রষ্ট হইয়াছিল। মাধব্য কহিলেন হাঁ সম্ভব বটে; সলিলে মগ্ন হইলে রোহিত মৎস্যে গ্রাস করিয়াছিল। রাজা অঙ্গুরীয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন আমি এই অঙ্গুরীয়কে যথোচিত তিরস্কার করিব। এই বলিয়া কহিলেন অরে অঙ্গুরীয়! প্রিয়ার কোমল করপল্লব পরিত্যাগ করিয়া জলে মগ্ন হইয়া তোমার কি লাভ হইল বল। অথবা তোমাকে তিরস্কার করা অন্যায়; কারণ অচেতন ব্যক্তি কখন গুণ গ্রহণ করিতে পারে না। নতুবা আমিই কি নিমিত্ত প্রিয়াকে পরিত্যাগ করিলাম। এই বলিয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে শকুন্তলাকে উদ্দেশ করিয়া কহিতে লাগিলেন প্রিয়ে! আমি তোমাকে অকারণে পরিত্যাগ করিয়াছি। অনুতাপানলে আমার হৃদয় দগ্ধ হইয়া যাইতেছে। দর্শন দিয়া প্রাণ রক্ষা কর।

 রাজা শোকাকুল হইয়া এইরূপ বিলাপ করিতেছেন এমত সময়ে চতুরিকা নাম্নী এক পরিচারিকা এক চিত্রফলক আনয়ন করিল। রাজা চিত্তবিনোদনার্থে ঐ চিত্রফলকে শকুন্তলার প্রতিমূর্ত্তি চিত্রিত করিয়াছিলেন। মাধব্য দেখিয়া বিস্ময়োৎফুল্ল লোচনে কহিলেন বয়স্য! তুমি চিত্রফলকে কি অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করিয়াছ। দেখিয়া কোন ক্রমেই চিত্র বোধ হইতেছে না। আহা মরি, কি রূপ লাবণ্যের মাধুরী! কি অঙ্গসৌষ্ঠব! কি অমায়িক ভাব! মুখারবিন্দে কি সলজ্জ ভাব প্রকাশ পাইতেছে! রাজা কহিলেন সখে! তুমি প্রিয়াকে দেখ নাই এই নিমিত্ত আমার চিত্রনৈপুণ্যের এত প্রশংসা করিতেছ। যদি তাঁহাকে দেখিতে, চিত্র দেখিয়া কখনই সন্তুষ্ট হইতে না। তাঁহার অলৌকিক রূপ লাবণ্যের কিঞ্চিৎ অংশ মাত্র এই চিত্রফলকে আবিভূত হইয়াছে। এই বলিয়া পরিচারিকাকে কহিলেন চতুরিকে! বর্ত্তিকা ও বর্ণপাত্র লইয়া আইস। অনেক অংশ চিত্রিত করিতে অবশিষ্ট আছে।

 এই বলিয়া চতুরিকাকে বিদায় করিয়া রাজা মাধব্যকে কহিলেন সখে! আমি স্বাদু শীতল নির্ম্মল জলপূর্ণ নদী পরিত্যাগ করিয়া এক্ষণে শুষ্ককণ্ঠ হইয়া মৃগতৃষ্ণিকায় পিপাসা শান্তি করিতে উদ্যত হইয়াছি। প্রিয়াকে সাক্ষাৎ পাইয়া পরিত্যাগ করিয়া, এক্ষণে চিত্রদৰ্শন দ্বারা চিত্ত বিনোদনের চেষ্টা পাইতেছি। মাধব্য কহিলেন বয়স্য! চিত্রফলকে আর কি লিখিবে?। রাজা কহিলেন বয়স্য! তপোবন ও মালিনী নদী লিখিব; যেরূপে হরিণ গণকে তপোবনে সচ্ছন্দে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে এবং হংস গণকে মালিনীতে জলক্রীড়া করিতে দেখিয়াছিলাম সে সমুদায়ও চিত্রিত করিব; এবং প্রথম দর্শন দিবসে প্রিয়ার কর্ণে শিরীষ পুষ্পের যেরূপ আভরণ দেখিয়াছিলাম তাহাও লিখিব।

 এইরূপ কথোপকথন হইতেছে এমত সময়ে প্রতীহারী আসিয়া রাজহস্তে এক পত্র সমৰ্পণ করিল। রাজা পাঠ করিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন। তখন মাধব্য জিজ্ঞাসা করিলেন বয়স্য! কোথাকার পত্র, পত্র পাঠ করিয়া বিষন্ন হইলে কেন?। রাজা কহিলেন বয়স্য! ধনমিত্র নামে এক বণিক্ সমুদ্র পথে বাণিজ্য করিত। সমুদ্রে নৌকা মগ্ন হইয়া তাহার প্রাণ ত্যাগ হইয়াছে। সে ব্যক্তি নিঃসন্তান। নিঃসন্তানের ধনে রাজার অধিকার। এই নিমিত্ত অমাত্য আমাকে তাহার সমুদায় সম্পত্তি আত্মসাৎ করিতে লিখিয়াছেন। দেখ, বয়স্য! নিঃসন্তান হওয়া কত দুঃখের বিষয়। বংশ লোপ হইল, নাম লোপ হইল, বহু কালে বহু কষ্টে উপার্জ্জিত ধন অন্যের হস্তে গেল। ইহা অপেক্ষা আক্ষেপের বিষয় আর কি হইতে পারে। এই বলিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন আমার লোকান্তর হইলে আমারও বংশ, নাম ও রাজ্যের এই গতি হইবেক।

 রাজার এইরূপ আক্ষেপ শুনিয়া মাধব্য কহিলেন বয়স্য! তুমি অকারণে এত পরিতাপ কর কেন। তোমার সন্তানের বয়স্ অতীত হয় নাই। কিছু দিন পরে তুমি অবশ্যই পুত্রমুখ নিরীক্ষণ করিবে। রাজা কহিলেন বয়স্য! তুমি আমাকে মিথ্যা প্রবোধ দাও কেন। উপস্থিত পরিত্যাগ করিয়া অনুপস্থিত প্রত্যাশা করা মূঢ়ের কর্ম্ম। আমি যখন নিতান্ত বিচেতন হইয়া প্রিয়াকে পরিত্যাগ করিয়াছি তখন আর আমার পুত্রমুখ নিরীক্ষণের আশা নাই।

 এইরূপে কিয়ৎ ক্ষণ বিলাপ করিয়া রাজা, অপুত্রতানিবন্ধন শোক সংবরণ পূর্ব্বক, প্রতীহারীকে কহিলেন, শুনিয়াছি, ধনমিত্রের অনেক ভার্য্যা আছে তন্মধ্যে কেহ অন্তঃসত্ত্বা আছেন কি না, অমাত্যকে এ বিষয়ের অনুসন্ধান করিতে বল। প্রতীহারী কহিল মহারাজ! অযোধ্যানিবাসী শ্রেষ্ঠীর কন্যা ধনমিত্রের এক ভার্য্যা। শুনিয়াছি শ্রেষ্ঠিকন্যা অন্তঃসত্ত্বা হইয়াছেন। তথন রাজা কহিলেন তবে অমাত্যকে বল, সেই গর্ভস্থ সন্তান ধনমিত্রের সমস্ত ধনের উত্তরাধিকারী হইবেক।

 এই আদেশ দিয়া প্রতীহারীকে বিদায় করিয়া রাজা মাধব্যের সহিত পুনর্ব্বার শকুন্তলাসংক্রান্ত কথোপকথন আরম্ভ করিতেছেন এমত সময়ে ইন্দ্রসারথি মাতলি দেবরথ লইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। রাজা দেখিয়া আহলাদিত হইয়া মাতলিকে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিয়া আসন পরিগ্রহ করিতে বলিলেন। মাতলি আসন পরিগ্রহ করিয়া কহিলেন মহারাজ! দেবরাজ যদর্থে আমাকে আপনকার নিকটে পাঠাইয়াছেন নিবেদন করি শ্রবণ করুন্। কালনেমির সন্তান দুর্জয় নামে কতক গুলি দানব দেবতাদিগের বিষম শত্রু হইয়া উঠিয়াছে। কতিপয় দিবসের নিমিত্ত আপনাকে দেবলোকে গিয়া দুর্জ্জয় দানব দলের দমন করিতে হইবেক। রাজা কহিলেন দেবরাজের এই আদেশে বিশেষ অনুগৃহীত হইলাম। পরে মাধব্যকে কহিলেন বয়স্য! অমাত্যকে বল, আমি কিয়দ্দিনের নিমিত্ত দেবকার্য্যে ব্যাপৃত হইলাম; তিনিই একাকী সমস্ত রাজকার্য্য পর্য্যালোচনা করুন। এই বলিয়া সসজ্জ হইয়া ইন্দ্ররথে আরোহণ পূর্ব্বক দেবলোক প্রস্থান করিলেন।