সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/ডুবুরী

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৬২-১৬৩)

ডুবুরী

 জলের তলায় ডুব দিয়ে যাদের কাজ করতে হয় তাদের বলে ডুবুরী। লোকে যে-সকল দামী মুক্তা দিয়ে গহনা বানায় সেই মুক্তাগুলি জন্মায় সমুদ্রের নীচে এক জাতীয় ঝিনুকের মধ্যে। ঝিনক থেকে একরকম রস বেরিয়ে খোলার মধ্যে ফোড়ার মতো হয়ে জমে থাকে-তাকে আমরা বলি ‘মুক্তা'। সবচেয়ে বড়ো আর ভালো যে-সব মুক্তা, সেগুলি জন্মায় একরকম পোকার উৎপাতে। সেই পোকার কেমন বদ অভ্যাস, সে সুবিধা পেলেই ঝিনুকের খোলার মধ্যে ঢুকে ঝিনুক বেচারাকে অস্থির করে তোলে। ঝিনুকও তখন বেশ করে রস ঢেলে দিয়ে তাকে জীবন্ত কবর দিয়ে রাখে। সেই পোকার কবরগুলিকে ডুবুরীরা সমুদ্রের তলা থেকে কুড়িয়ে আনে, আর শৌখিন লোকে হাজার হাজার টাকা দিয়ে সেগুলি কিনে যত্ন করে তুলে রাখে।

 যে-সব মুক্তা অল্প জলে থাকে ডুবুরীরা কেবল সেইগুলিকেই আনতে পারে-কারণ বড় জোর দেড়শো হাতের বেশি এ-পর্যন্ত কোনো ডুবুরীই নামতে পারে নি। এমন অনেক ডুবুরী আছে যারা শুধু একটা পাথর-বাঁধা দড়ি নিয়ে দম বন্ধ করে প্রায় দেড় মিনিট কি দুমিনিট ত্রিশ-চল্লিশ হাত জলের নীচে থাকতে পারে। কিন্তু আজকালকার ডুবুরীরা একরকম অদ্ভুত পোশাক পরে জলে নামে। ডুবুরীর পিঠে একটা দড়ি বাঁধা থাকে, তাই টেনে ডুবরী উপরের লোকদের ইশারা করে আর তারা তাকে উঠায় নামায়। ডুবুরীর মাথায় একটা লোহার মুখোশ-তাতে পুরু কাচের জানালা বসানো, তাই দিয়ে সে দেখতে পায়—আর টুপির আগায় একটা নল তা দিয়ে উপর থেকে বাতাস আসে, তবে সে নিশ্বাস ফেলতে পারে। পোশাকটি এমন যে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোনোখান দিয়ে এক ফোঁটাও জল ঢুকতে পারে না। ডুবরীদের পায়ে প্রকাণ্ড ভারি সীসার জুতো আর পিঠেও সীসার বোঝা। জলের নীচে কাজ করার বিপদ অনেকরকম। প্রথম ভয় এই যে যদি পোশাকের মধ্যে কোনোরকমে জল ঢুকতে পারে তবে ডুবুরীকে পিষে থ্যাঁৎলা করে ফেলবে। পোশাকটিকে সমস্ত ক্ষণ বাতাস দিয়ে ফুটবলের মতো পাম্প করে রাখতে হয়—তা হলেই ডুবুরী আর জলের চাপ টের পায় না। জোরে পাম্পকরা বাতাস যখন পোশাকের মধ্যে ঢোকে তখন ডুবুরীর গায়ের সমস্ত রক্ত আর রস বোতলে-পোরা সোডা ওয়াটারের মতো সেই বাতাস শুষে নেয়। এ অবস্থায় যদি তাকে হঠাৎ উপরে টেনে তোল, তবে সোডার বোতল খুললে যা হয় তার শরীরের মধ্যে তেমনি একটা কাণ্ড চলতে থাকে। এইরকমে কত লোক মারা গেছে। সেইজন্য তুলবার সময়ে খুব সাবধানে আস্তে আস্তে দড়ি টানতে হয় আর মাঝে মাঝে থামাতে হয়। যদি পোশাকটি ভালো করে এঁটে পরা না হয়, আর সীসার বোঝাটি কোনোরকম খুলে যায় তবে ডুবুরী তৎক্ষণাৎ বিদ্যুতের মতো ছিট্‌কিয়ে উপরে ভেসে উঠবে। তাতেও তার হাড়গোড় চুরমার হয়ে যেতে পারে। এসব ছাড়া হাঙর বা অন্য জলজন্তুর ভয় তো আছেই। ডুবুরীরা হাঙরের চাইতেও ভয় করে ‘অক্টোপাস’কে। পিটার স্নেল একজন নামজাদা ডুবুরী ছিল। সে একবার জলে নামতেই একটা প্রকাণ্ড অক্টোপাস শুড়ের মতো আট পা বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। ভয়ে স্নেল পাগলের মতো ছুরি চালাতে চালাতে তার দড়ি ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল। অনেক টানাটানির পর যখন তাকে প্রায় আধমরা অবস্থায় উপরে তোলা হল, তখনো জানোয়ারটার কয়েকটা কাটা পা তার গায়ে লেগে ছিল। তার ওজন প্রায় আধ মণ।

 আর একটি জিনিস আছে যাকে ডুবুরী দিয়ে কুড়িয়ে এনে লোকে তার ব্যবসা করে। তাকে আমরা বলি ‘স্পঞ্জ’ (sponge)—সেই যে ফুটোওয়ালা নরম জিনিস যাতে জল শুষে নেয় আবার চাপ দিলে জল বেরিয়ে যায়। স্পঞ্জ জিনিসটা একরকম অদ্ভুত জলজন্তুর খোলস বা কঙ্কাল বা বাসা—যা ইচ্ছা বলতে পার। সমুদ্রের তলায় স্পঞ্জের দল সার বেঁধে মার্টি আঁকড়িয়ে পড়ে থাকে, ডুবুরীরা তাকে সেখান থেকে ছিনিয়ে আনে।

 রাউল নামে একজন লোক স্পঞ্জ তুলবার জন্য একরকম ডুবুরী গাড়ি তৈরি করেছেন। দুজন ডুবুরী তার মধ্যে স্বচ্ছন্দে বসতে পারে। স্পঞ্জ দেখবার জন্য গাড়ির সামনে একটা উজ্জ্বল আলো থাকে। গাড়ির নীচে চাকা আর পিছনে দুটা দাঁড়, তাতেই তার চলাফিরা চলে। আর সামনে ডাণ্ডার আগায় একটা হাঁ-করা মতন জিনিস আছে—তা দিয়ে স্পঞ্জ আঁকড়ে আনে।

 আজকাল ডুবুরীর পোশাকের নানারকম উন্নতি হয়েছে—কোনোটার পিঠে বাতাসের বন্দোবস্ত, তার আলাদা নল লাগে না। কোনোটার মধ্যে টেলিফোনের কল, উপরের সঙ্গে কথাবার্তা চলে—আর কোনোটার এমন সুবিধা আছে যে ডুবুরী ইচ্ছা করলে কারও সাহায্য ছাড়াই উপরে উঠতে পারে।

সন্দেশ-বৈশাখ, ১৩২২