সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/দেশ-বিদেশের গল্প/ওয়াসিলিসা

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ৬৯-৭১)
ওয়াসিলিসা


 ওয়াসিলিসা এক সওদাগরের মেয়ে। তার মা ছিল না, কেউ ছিল না— ছিল খালি এক দুষ্টু সৎমা আর ছিল সে সৎমার দুটো ডাইনির মত মেয়ে।

 ওয়াসিলিসার মা যখন মারা যান, তখন তিনি তাকে একটা কাঠের পুতুল দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, “একে কখনো ছেড়ো না, সর্বদা কাছে কাছে রেখো, আর যখন তোমার বিপদ-আপদ ঘটবে, একে চারটি কিছু খেতে দিও। তবেই দেখবে, এ মানুষের মত তোমার সঙ্গে কথা বলবে; তখন এর পরামর্শ মতো চোলো।” তার পরে এতদিনে ওয়াসিলিসা বড় হয়ে উঠেছে।

 সৎমা তার মেয়েদের সঙ্গে মিলে কেবল ওয়াসিলিসার অনিষ্ট চেষ্টা করত। ওয়াসিলিসা দেখতে যেমন সুন্দর, তার কথাবার্তা তেমনি মিষ্টি। গ্রামের যত লোক সবাই তাকে ভালবাসে। আর সেই সৎমাটার যে দুটো মেয়ে —তাদের দাঁত যেমন উঁচু, চোখ তেমনি টেরা, নাক তার চেয়েও বাঁকা, আর তার উপরে এমনি দুষ্টু আর হিংসুকে আর ঝগড়াটে, তাদের কে ভালোবাসবে? তাই তারা হিংসায় ওয়াসিলিসাকে ধরে মারত। গ্রামের এক কিনারায় ওয়াসিলিসাদের বাড়ি আর বাড়ির পাশেই প্রকাণ্ড বন। সে বনের মধ্যে সবুজ মাঠের ওপরে ডাইনিবুড়ি বাবায়াগার বাড়ি। সে বুড়ি মানুষ খায়, সুন্দর মেয়েদের ধরতে পেলে তো খুব উৎসাহ করেই খায়।

 একদিন রাত্রে দুষ্টু সৎমা তার মেয়েদের বলল, “এক কাজ কর। ঘরের আগুনটা নিবিয়ে দে ত। তা হলেই ওয়াসিলিসাকে আবার আগুন আনবার জন্য সেই সবুজ মাঠে বাবায়াগার বাড়িতে পাঠানো যাবে; আর বাবায়াগা তাকে ধরে গিলে ফেলবে। কেমন মজা!” যেই এ কথা বলা, অমনি বড় মেয়েটা উঠে ইচ্ছে করে ছাইমাটি চাপা দিয়ে আগুন নিবিয়ে দিল। আর সকলে চেঁচাতে লাগল, “ঐ যা! আগুন তো নিবে গেল! ওয়াসিলিসা, ওয়াসিলিসা, শিগ্‌গির ওঠ। বনের মধ্যে সবুজ মাঠ আছে, তার মধ্যে বাবায়াগার বাড়ি, তার বাড়ির আগুন নাকি কখনো নিবে যায় না। শিগ্‌গির যাও, দৌড়ে যাও, সেই আগুন খানিকটা নিয়ে এস।”

 এই না ব’লে তারা ওয়াসিলিসার চুল ধরে হিড় হিড় ক’রে টেনে তাকে বাড়ির বাইরে তাড়িয়ে দিয়ে, ঘরের খিল এঁটে দিল। ওয়াসিলিসা বাইরে বসে কাঁদছে, এমন সময় তার সেই ছোট কাঠের পুতুলের কথা মনে হল। তখন সে তাড়াতাড়ি তার কাপড়ের মধ্যে থেকে পুতুলটাকে বের করে তার মুখে একটু খাবার দিয়ে বলতে লাগল, “কাঠের পুতুল, খাবার খাও, আবার তুমি জ্যান্ত হও, আমার সঙ্গে কথা কও।” অমনি কাঠের পুতুলের চোখ দুটো জ্বলে উঠল, ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল— তারপর সে বলতে লাগল, “কাঠের পুতুল সঙ্গে রয়, ওয়াসিলিসার কিসের ভয়? তুমি ভয় পেও না, বাবায়াগার বাড়ি সোজা চলে যাও।”

 ওয়াসিলিসা চলতে লাগল। রাত গেল, সকাল গেল, দুপুর গেল, তখন দেখা গেল সবুজ মাঠ, তার ঠিক মধ্যখানে ভাঙাচোরা সাদা বাড়ি, তার গায়ে সারি সারি মড়ার খুলি, তার দরজা জানালা ফটক কবাট আস্ত আস্ত হাড়ের তৈরী। হুড়্‌কো, কবজা, কাঁটা, পেরেক কোথাও কিছু নেই— কিছু দিয়ে বাঁধা নেই, জোড়া নেই, অথচ বাড়িখানা চারটে পাখির ঠ্যাঙের উপর ঠিক দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 ওয়াসিলিসা অবাক হয়ে দেখছে, এমন সময় হঠাৎ একটা সাদা লোক ঝক্‌ঝকে সাদা পোশাক পরে, সাদা ঘোড়ায় চড়ে সাঁই সাঁই করে কোথা থেকে ছুটে এলো। এসেই, সোজা বাড়ির ফটকের উপরে ছুটে পড়ল আর ধাঁ করে বাড়ির সঙ্গে মিশে গেল। ওয়াসিলিসা চেয়ে দেখল, তখন বিকেল হয়ে এসেছে, রোদ পড়ে আসছে।

 তারপর একজন লোক এল, রাঙা সূর্যের মত লাল তার রঙ—তার পোশাক, তার ঘোড়া, সবই লাল। সেও তেমনি ছুটে গিয়ে বাড়ির মধ্যে মিশে গেল। ওয়াসিলিসা দেখল, সন্ধ্যে হয়েছে, চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে।

 তারপর একজন এল অন্ধকারের মতো কালো কালো পোশাক, কালো ঘোড়া। সে যেই বাড়ির মধ্যে মিশে গেল আর চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেবল সেই বাড়ির গায়ে মড়ার খুলিগুলো আপনা থেকে ঝক্‌ঝক্‌ করে জ্বলে উঠল—আর দাঁত বের করে চারদিকে আলো ছড়াতে লাগল।

 তারপরে একটা প্রকাণ্ড হামানদিস্তা হাঁকিয়ে বাবায়াগা নিজে এসে হাজির। সে এসেই তো ওয়াসিলিসার গন্ধ পেয়ে তাকে ধরে নিয়ে গেল। ওয়াসিলিসা আগুন নিতে এসেছে শুনেই সে বলল, “বটে! আগুনের বুঝি দাম লাগে না? তিন দিন আমার বাড়িতে কাজ কর—যদি ভালো কাজ করতে পারিস আগুন পাবি; আর, তা যদি না পারিস তোকে আমি ঝোল রেঁধে খাব। আচ্ছা, এখন আমার খাবারগুলো উনুন থেকে নামিয়ে আমায় দে তো।”

 ওয়াসিলিসা খাবার এনে দিল। বুড়ি চেটেপুটে খেয়ে বলল, “কাল সকালে আমি বেরিয়ে যাব। সন্ধ্যার সময় এসে যেন দেখতে পাই—আমার ঘর ঝাঁট দেওয়া হয়েছে, আমার রান্না ঠিকমত করা হয়েছে, আর ঐ কোণে এক ঝুড়ি সোনার ধান দেখবি তার মধ্যে অনেক কাঁকর, অনেক খুদ, আর তার চাইতেও বেশি কালো ধান মেশানো আছে—সমস্ত ঝেড়ে বেছে রাখিস। খবরদার, কিছু ভুল হয় না যেন।”

 ওয়াসিলিসা বসে বসে কাঁদতে লাগল। তখন তার কাঠের পুতুলের কথা মনে হ’ল। সে পুতুলের মুখে একটু খাবার দিয়ে বলতে লাগল, “কাঠের পুতুল! খাবার খাও, আবার তুমি জ্যান্ত হও, আমার সঙ্গে কথা কও।” কাঠের পুতুলের চোখ দুটো জ্বলে উঠল, ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল, সে বলতে লাগল,—“কাঠের পুতুল সঙ্গে রয়, ওয়াসিলিসার কিসের ভয়? তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও গিয়ে।”

 ওয়াসিলিসা ঘুমোতে গেল। সকালবেলায় বাবায়াগা তার হামানদিস্তায় চড়ে বেরিয়ে গেল। আর কি আশ্চর্য! ঘরদোর সব আপনা থেকে ঝাঁট হয়ে গেল। খাবারগুলো উনুনে চড়ে আপনা থেকে সিদ্ধ হতে লাগল। ওয়াসিলিসা অবাক হয়ে সেই ধানগুলো দেখতে গিয়ে দেখে তার কাঠের পুতুল সমস্ত ধান বেছে সোনার ধান, কালো ধান, কাঁকর আর খুদ সব আলগা করে ফেলেছে!

 বিকেলবেলা সাদা লোকটা ফিরে এল, সন্ধ্যার সময় লাল লোকটা ফিরে এল আর ঘুট্‌ঘুটে অন্ধকার রাত্রে কালো লোকটা ফিরে এল—তারপর ঝমঝম খট্‌খটাং করে হামানদিস্তা হাঁকিয়ে বাবায়াগা ঘরে এল। এসেই সে হামানদিস্তার বাঁটটা দিয়ে ঘরের সব জায়গায় ধাঁই ধাঁই ক’রে মেরে দেখতে লাগল, কোনখান থেকে ধুলো পড়ে কিনা! তারপর যখন সে দেখল ঝাঁট দেওয়াও ঠিক হয়েছে, খাবারও রান্না হয়েছে, ধানও বাছা হয়েছে, তখন সে রেগে চিৎকার করে বলতে লাগল, “হতভাগি মেয়ে, কে তোকে বাঁচিয়েছে—শিগ্‌গির আমায় বল্‌।” ওয়াসিলিসা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমার মা মারা যাবার সময় আমায় আশীর্বাদ করেছিলেন, তাতেই আমি বেঁচেছি।” এই না শুনে ডাইনিবুড়ি ভয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, “ওরে বাবারে! কার আশীর্বাদ নিয়ে আমার বাড়ি এসেছ রে! আমার সর্বনাশ করবে যে! এই নে তোর আগুন নে—আমার বাড়ি থেকে শিগ্‌গির বেরো।” এই বলে সে ওয়াসিলিসাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল, আর একটি মড়ার খুলি তাকে ছুঁড়ে দিল।

 ওয়াসিলিসা একটা লাঠির আগায় খুলিটাকে চড়িয়ে বাড়ি নিয়ে গেল। কিন্তু বাড়িতে নিলে কি হবে? তার যে সেই সৎমা আর তার দুটো দুষ্টু মেয়ে, তাদের তো কেউ কোনদিন আশীর্বাদ করেনি—তারা মহা খুশি হয়ে যেই আগুনটা নিতে গিয়েছে অমনি তাদের গায়ে আগুন ধরে গিয়ে তারা তো মরলই, বাড়িঘর সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

 ওয়াসিলিসা আবার বসে কাঁদতে লাগল। তখন কাঠের পুতুলের কথা মনে হল। পুতুলের মুখে খাবার দিয়ে বলল, “কাঠের পুতুল, খাবার খাও, আবার তুমি জ্যান্ত হও, আমার সঙ্গে কথা কও।” কাঠের পুতুল জেগে উঠে বলল, “কাঠের পুতুল সঙ্গে রয়, ওয়াসিলিসার কিসের ভয়? তুমি রাজার কাছে যাও তিনি তোমায় সুখী করবেন।”

 ওয়াসিলিসা তখন রাজার বাড়ি চলল। এমন সুন্দর মেয়ে, এমন মিষ্টি কথা বলে, কেউ তাঁকে বারণ করল না, কেউ বাধা দিল না। ওয়াসিলিসা একেবারে রাজসভায় রাজার সামনে গিয়ে উপস্থিত।

 রাজা এমন চমৎকার মেয়ে কখনো কোথাও দেখেন নি—তিনি তার কথা শুনবেন কি—তাড়াতাড়ি সিংহাসন থেকে উঠে পড়লেন, বললেন, “আহা কি সুন্দর মেয়েটি গো! তুমি কার মেয়ে? কি তোমার দুঃখ? তুমি আমায় বিয়ে কর—আমার রাজ্যের রানী হয়ে থাক—আমি তোমার সব দুঃখ দূর করব।”

 এমনি করে ওয়াসিলিসা রানী হলেন—আর সেই কাঠের পুতুল সোনার খাটে মখমলের গদিতে, রেশমের চাদরের উপর ঝক্‌ঝকে পোশাক পরে শুয়ে থাকত।

সন্দেশ—১৩২০