পাতা:অবরোধ বাসিনী.pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

তাই ত, পর্দ্দানশীনদের ধরাপৃষ্ঠে থাকিবার প্রয়োজন কি? দন্ত কড়মড় করিয়া,— “বউমা’রা শুন ত-” বলিয়াই অতি ক্রোধে কর্ত্তার বাকবোধ হইল। তখন তাঁহার “গোস্ব্বায় অজুদ কাঁপে, আঁখি হইল লাল”-তিনি বউমাদের বিনা লুণে চিবাইয়াত খাইবেন, না, আস্ত গিলিবেন, তাহা ঠিক করিতে পারিতেছিলেন না!


অবরোধ বাসিনী - ৩৭

[৩৭]

একবার পশ্চিম দেশ হইতে ট্রেণ হাবড়ায় আসিবার সময় পথে বালী ষ্টেশনে তিনজন বোরকাধারিণী লোক স্ত্রীলোকদের কক্ষে উঠিল। কক্ষে আরও অনেক মুসলমান স্ত্রীলোক ছিল। ট্রেণ ছাড়িলে পরও তাহারা সবিস্ময়ে দেখিতে লাগিল যে নবাগতা তিনজন বোরকার নেকাব (মুখাবরণ) তুলিল না। তখন তাহাদের মনে সন্দেহ হইল যে ইহারা নাকি জানি কি করিবে। আর তাহারা লম্বাও খুব ছিল। খোদা খোদা করিয়া লিলুয়া ষ্টেশনে ট্রেণ থামিলে যখন মেয়ে টিকেট কালেকটার তাহাদের কামরায় আসিলেন, তখন সকলেই তাঁহাকে ঐ বোরকাধারিণীদের বিষয় বলিল। টিকেট কালেকটার তাহাদের দিকে অগ্রসর হইতে না হইতে তাহাদের একজন ষ্টেশনের বিপরীত দিকে ট্রেণের জানালা দিয়া লাফাইয়া পলাইয়া গেল; তিনি “পুলিশ-পুলিশ” বলিয়া চেঁচাইতে চেঁচাইতে একজনকে ধরিয়া নেকাব তুলিয়া, দেখেন,—তাহার মুখে ইয়া দাড়ী,—ইয়া গোঁফ! তিনি ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! বোরকার ভিতর দাড়ী গোঁফ!”


অবরোধ বাসিনী - ৩৮

[৩৮]

আমার পরিচিতা জনৈকা শি-ডাক্তার মিস শরৎকুমারী মিত্র বলিয়াছেন, “বাবা! আপনাদের-মুসলমানদের বাড়ী গেলে আমাদের যা নাকাল হতে হয়! না পাওয়া যায় সময়মত একটু গরম জল; না পাওয়া যায় একখণ্ড ন্যাকড়া!”

একবার তাঁহাকে বহুদূর হইতে একজন ডাকিতে আসিয়া জানাইল যে বউবেগমের দাঁতে ব্যথা হইয়াছে। তিনি যথাসম্ভব দাঁতের ঔষধ এবং প্রয়োজন বোধ করিলে দাঁত তুলিয়া ফেলিবার জন্য যন্ত্রপাতি সঙ্গে লইয়া গিয়াছেন। সেখানে দিয়া দেখেন, দাঁতে বেদনা নহে,—প্রসব বেদনা! তিনি এখন কি করেন? ভাগলপুর শহর হইতে জমগাঁও চারি ক্রোশ পথ। এত দূর হইতে আবার সেই একই ঘোড়ার গাড়ীতে ফিরিয়া যাওয়াও অসম্ভব; কারণ ঘোড়া কান্ত হইয়াছে। জমগাঁও শহরতলী,—পাড়া গ্রামের মত স্থান, সেখানে ঘোড়ার গাড়ী কিম্বা পাল্কী পাওয়া যায় না।

কোন প্রকারে ভাগলপুরে ফিরিয়া আসিয়া তৎকালীন উপযোগী যন্ত্রপাতি লইয়া পুনরায় জমগাঁও যাইতে যাইতে রোগিনীর দফা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা। মিস মিত্র সে বাড়ীর কর্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে এরূপ মিথ্যা কথা বলিয়া তাঁহাকে অনর্থক ডাকা হইল কেন? উত্তরে কর্ত্রী বলিলেন, “পুরুষ চাকরের দ্বারা ডাক্তারনীকে ডাকিতে হইল, সুতরাং তাহাকে দাঁতে ব্যথা না বলিয়া আর কি বলিতাম? তোবা ছিয়া! মর্দ্দুয়াকে ও কথা বলিতাম কি করিয়া? আপনি কেমন ডাক্তারণী যে, লোকের কথা বুঝেন না?”


অবরোধ বাসিনী - ৩৯

[৩৯]

সমাজ আমাদিগকে কেবল অবরোধ-কারাগারে বন্ধ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই। হজরতা আয়শা সিদ্দিকা নাকি ৯ বৎসর বয়সে বয়োপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন; সেই জন্য সম্ভ্রান্ত মুসলমানের ঘরের বালিকার বয়স আট বৎসর পার হইলেই তাহাদের উচ্চহাস্য করা নিষেধ, উচ্চৈস্বরে কথা বলা নিষেধ, দৌড়ান লাফান ইত্যাদি সবই নিষেধ। এক কথায়, তাহার ন্নাচড়াও নিষেধ। সে গৃহকোণে মাথা গুঁজিয়া বসিয়া কেবল সূচি-কর্ম্ম করিতে থাকিবে,—নড়িবে না। এমনকি দ্রুতগতি হাঁটিবেও না।