পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

সেই তাড়কার ছেলে মারীচের ফাঁকি। ঐ দুষ্ট অনেক সময় হরিণের সাজ ধরিয়া মুনিদিগকে মারিতে আসে।’

 কিন্তু সীতা সেই হরিণ দেখিয়া এতই ভুলিয়া গেলেন যে লক্ষ্মণের কথা তাঁহার কানেই গেল না। তিনি রামকে বলিলেন, কী সুন্দর হরিণ! ওটি আমাকে ধরিয়া দিতেই হইবে! জীবন্ত ধরিতে পারিলে আমরা উহাকে পুষিব, আর দেশে যাইবার সময় সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। আর জীবন্ত ধরিতে না পারিলেও, উহার চামড়ায় সুন্দর আসন হইবে।’

 লক্ষ্মণকে সাবধানে পাহারা দিতে বলিয়া রাম হরিণ ধরিতে চলিলেন। দুষ্ট রাক্ষস কতই ছল জানে! এক এক বার কাছে আসে, আবার বনের ভিতরে লুকায়, আবার খানিক দূর গিয়া গাছের আড়াল হতে উঁকি মারে। এরূপ করিয়া সে তাঁহাকে অনেক দূর হইয়া গেল। রাম যতক্ষণ মনে করিয়াছিলেন যে তাহাকে ধরিতে পারিবেন, ততক্ষণ ক্রমাগত তাহার পিছু-পিছু ছুটিয়াছিলেন। যখন দেখিলেন যে আশ্রম হইতে অনেক দূরে চলিয়া আসিয়াছেন, তবুও তাহাকে ধরিতে পারিতেছেন না, তখন তিনি একটা তীর ছুঁড়িয়া মারিলেন।

 সেই তীরের ঘায় রাক্ষসের হরিণের সাজ ঘুচিয়া গেল। এখন তাহার প্রাণ যায়-যায়। মরিবার সময় সে বিকট রাক্ষস হইয়া ঠিক রামেরই মতন স্বরে ‘হায় সীতা! হায় লক্ষ্মণ!’ বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। তাহা শুনিয়া রাম বুঝিতে পারিলেন যে সর্বনাশ হইয়াছে। এ শব্দ সীতার কানে গেলে কি আর রক্ষা থাকিবে? এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে তিনি ব্যস্ত হইয়া আশ্রমের দিকে ফিরিলেন।

 এদিকে সীতা আশ্রম হইতে সেই দুষ্ট রাক্ষসের কান্না শুনিতে পাইয়া রামের জন্য অস্থির হইয়া উঠিলেন। তিনি লক্ষ্মণকে বলিলেন, ‘হায় হায়! না জানি কী সর্বনাশ হইল! লক্ষ্মণ শীঘ্র যাও! নিশ্চয় তিনি রাক্ষসের হাতে পড়িয়াছেন!’

 কিন্তু লক্ষ্মণকে রাম সীতার নিকট থাকিতে বলিয়া গিয়াছেন, কাজেই তিনি সীতাকে ছড়িয়া যাইতে চাহিলেন না। তখন সীতা লক্ষ্মণকে এই বলিয়া গালি দিতে লাগিলেন ‘বুঝিয়াছি, তাঁহাকে রাক্ষসে মারিয়া ফেলে ইহাই তুমি চাও। এমন ভাই তুমি!

 তাহা শুনিয়া লক্ষ্মণ বলিলেন, “দাদাকে মারিতে পারে, ত্রিভুবনে এমন কেহ নাই। আপনি কেন আমাকে এইরূপ করিয়া বলিতেছেন? আপনাকে একলা ফেলিয়া যাওয়া কি আমার উচিত? আপনার কোন ভয় নাই। যে শব্দ শুনিয়াছেন উহা রাক্ষসের ফাঁকি। রাক্ষসদিগের সঙ্গে আমাদের এখন শত্রুতা; সুতরাং তাহারা আমাদের অনিষ্ট করিবার জন্য কতই চেষ্টা করিবেন। আপনি দুঃখ করিবেন না, স্থির হউন।’

 কিন্তু সীতা আরও রাগিয়া বলিলেন, ‘তবে রে নিষ্ঠুর দুষ্ট লক্ষ্মণ, রামের বিপদ হইলেই বুঝি তোর সুখ হয়? তোর মতন পাপী তো আর নাই! তোকে বুঝি ভরত পাঠাইয়াছে? না তুই নিজেই দুষ্ট বুদ্ধি আঁটিয়া রামের সঙ্গে আসিয়াছিস?’

 এ কথা শুনিয়া লক্ষ্মণের মনে যে কী কষ্ট হইল তাহা কী বলিব। তিনি বলিলেন, ‘আপনাকে আমি মায়ের মতন ভক্তি করি। কিন্তু আপনি এমন শক্ত কথা আমাকে বলিতেছেন যে, আমার তাহা কিছুতেই সহ্য হইতেছে না। যাহা হউক, এই আমি চলিলাম, বনের দেবতারা আপনাকে রক্ষা করুন। সাবধান হইয়া ঘরে বসিয়া থাকুন, যেন দাদার সঙ্গে ফিরিয়া আসিয়া আবার আপনাকে দেখিতে পাই।’ এই বলিয়া লক্ষ্মণ সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। যাইবার সময়