পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

হনুমান এইরূপ কত স্থান দেখিল, কিন্তু কোথাও সীতাকে দেখিতে পাইল না।

 এক জায়গায় রাবণের পুষ্পক রথ রহিয়াছে। বিশ্বকর্মা তাহা ব্রহ্মার জন্য মণি-মুক্তা দিয়া প্রস্তুত করিয়াছিলেন। ব্রহ্মা সেই রথ কুবেরকে দেন। কুবেরের নিকট হইতে রাবণ তাহা কাড়িয়া আনে। হনুমান সেই রথের উপর উঠিয়া দেখিল।

 রাবণের বাড়িতে সকলে খাওয়া দাওয়া সারিয়া ঘুমাইয়াছে। সেখানে কত আশ্চর্য জিনিসই হনুমানের চোখে পড়িল! সোনার জানালা, মানিকের সিঁড়ি, হাতির দাঁতের মূর্তি, স্ফটিকের থাম—সকল আশ্চর্য! ইহার মধ্যে আবার সকলের চেয়ে আশ্চর্য রাবণের শুইবার স্থানটি স্ফটিকের বেদী, তাহার উপরে নীলকান্ত মণির খাট, তাহাতে সোনালী কাজ-করা হাতির দাঁতের খুঁটি। কলের পুতুলসকল পাখা হাতে লইয়া সেই খাটে বাতাস করিতেছে।

 রাণী মন্দোদরীকে দেখিয়া একবার হনুমান মনে করিল, ‘এই বুঝি সীতা। কিন্তু আবার ভাবিল, সীতা এমন সুখে ঘুমাইতেছেন, তাহা কখনই হইতে পারে না। ইনি নিশ্চয়ই অন্য কেহ হইবেন।’

 এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সে রাবণের খাবার ঘরে গেল। কত জন খাইতে খাইতে সেইখানেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সোনার থালা ঘটিতে, মণির কাজ করা স্ফটিকের বাটিতে কতরকম খাবার জিনিস রহিয়াছে তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। মাংসের ব্যঞ্জনই বা কতরকমের—হরিণের মাংস, শুয়োরের মাংস, মহিষের মাংস, গণ্ডারের মাংস, ভেড়া, ছাগল, মোরগ আর ময়ূরের মাংস, কিছুরই অভাব নাই। তাহা ছাড়া মাছ তো আছেই। হনুমান সকলই দেখিল।

 সেখানে অনেক মেয়ে রহিয়াছেন। কেহ দেবতার কন্যা, কেহ নাগের কন্যা; দেখিতে সকলেই সুন্দর। আবার বিকট চেহারা এবং ভয়ঙ্কর দাঁতওয়ালা রাক্ষসের মেয়েও অনেক আছে। কিন্তু সীতা কোথাও নাই।

 হনুমান অনেক করিয়া খুঁজিল। ঘরের পর বাগান, বাগানের পর ঘর, কিছুই সে বাকি রাখিল না। কিন্তু দেখিল, সীতা কোথাও নাই। তখন মনের দুঃখে সে বলিল, ‘হায় হায়! এত করিয়াও সীতাকে দেখিতে পাইলাম না! হয়ত রাবণ তাহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে, না হয় তিনি নিজেই মরিয়া গিয়াছেন। আমার এত পরিশ্রম সকলই বৃথা হইল। এখন আমি কোন মুখে ফিরিয়া যাইব? তাহার চেয়ে আমার মরিয়া যাওয়া ভাল!’ তারপর আবার সে মনে করিল, ‘না, মরিব কেন? এখনও ত সকল স্থান দেখা হয় নাই। আরো ভাল করিয়া খুঁজি।’

 এই বলিয়া সে আবার প্রাণপণে খুঁজিতে খুঁজিতে একটি অশোক বন দেখিতে পাইল। সেই বনে যাইবামাত্র তাহার মনে হইল, ‘এইখানে বোধহয় সীতাকে দেখিতে পাইব। হয়ত এইদিক দিয়া তিনি আসিবেন।’ এই মনে করিয়া সে একটি শিংশপা অর্থাৎ শিশু গাছের পাতার আড়ালে লুকাইয়া চারিদিক দেখিতে লাগিল।

 এমন সময় একটি মেয়ে সেইদিক দিয়া আসিলেন। না খাইয়া তাহার শরীর ভয়ানক রোগা আর ময়লা হইয়া গিয়াছে, কিন্তু তবুও তিনি দেখিতে আশ্চর্যরূপ সুন্দর। রাক্ষসীরা তাঁহাকে ঘিরিয়া আছে আর তিনি ক্রমাগত নিশ্বাস আর চোখের জল ফেলিয়া, কেবল যেন কাহার কথা ভাবিতেছেন। চুল বাঁধেন নাই, একখানি মাত্র হলদে রঙের ময়লা কাপড় পরিয়া আছেন। হনুমান তাঁহাকে দেখিয়াই বুঝিতে পারিল যে ইনিই সীতা। কারণ, তাহারা ঋষ্যমূক পর্বতে