পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
১৩৫

থাকিয়া যে মেয়েটিকে দেখিতে পাইয়াছিল, ইনি তাঁহারই মতন দেখিতে।

 ততক্ষণে রাত্রি প্রভাত হইয়া গিয়াছে, সুতরাং তখন আর সীতার সহিত কথা বলিবার সুবিধা হইল না। তাই হনুমান আবার রাত্রির জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল। এদিকে সীতা বসিয়া বসিয়া কেবল কাঁদিতেছেন। ভয়ঙ্কর রাক্ষসীরা তাঁহাকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। তাহাদের কোনটা লম্বা, কোনটা কুঁজো, কোনটা কানা। কোনটার কান হাতির কানের মত চ্যাটালো; কাহারও কান আবার ঘোড়ার কানের মত সূচালো। কোনটার গলা হাড়গিলার গলার মতন লম্বা। কোনটার গায় এত লোম যে দেখিলে মনে হয় যেন কম্বল পরিয়াছে। কোনটার মুখ শুয়োরের মুখের মতন, কোনটার মুখ বাঘের মুখের মতন, কোনটার মুখ শেয়ালের মুখের মতন। কোনটার হাতির পায়ের মতন পা। এক-একটার আবার হাতির শুঁড়ের মতন শুঁড়ও আছে। কোনটার জিহ্বা লক-লক করিয়া ঝুলিয়া রহিয়াছে।

 চারিধারে এই সকল রাক্ষসী অস্ত্রশস্ত্র লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহাদের মাঝখানে সীতা সেই শিংশপা গাছের তলায় বসিয়া কেবলই কাঁদিতেছেন।

 তারপর যখন অনেক রাত্রি হইল, তখন রাবণ সেখানে আসিল। সে আসিয়া সীতাকে খুশি করিবার জন্য কতই মিষ্ট কথা কহিল, আবার কত লোভও দেখাইল। কিন্তু সীতা তাহার কোন কথাই শুনিলেন না। তিনি তাহাকে বলিলেন, ‘ওরে দুষ্ট, পাপ করাই বুঝি তোমার কাজ? তুমি যেমন লোক, রাম লক্ষ্মণ আসিয়া তোমাকে তেমনি সাজা দিবেন। যদি তুমি ভাল চাহ, এখনই আমাকে ফিরাইয়া দিয়া রামকে সন্তুষ্ট কর, নতুবা তোমার আর রক্ষা নাই। তুমি তো মরিবেই, তোমার লঙ্কায় আর একটি লোকও বাঁচিয়া থাকিবে না।’

 এই কথায় রাবণ ভয়ানক রাগিয়া বলিল, ‘আমি আর দুই মাস দেখিব। তাহার পরে যদি তুমি আমার সঙ্গে ভাল করিয়া কথা না বল, তবে তোমাকে কাটিয়া রাঁধিয়া খাইব!’ সীতা বলিলেন, ‘আমার এমন ক্ষমতা আছে যে আমি তোমাকে এখনই ভস্ম করিতে পারি। কেবল রাম আমাকে অনুমতি দেন নাই বলিয়া চুপ করিয়া আছি। তুমি কুবেরের ভাই, আর নিজে এমন বীর। তুমি কেন রামকে ফাঁকি দিয়া আমাকে লইয়া আসিলে?'

 রাবণ দেখিল যে সীতা কিছুতেই তাহার কথায় সন্তুষ্ট হইতেছেন না। তখন সে রাক্ষসীদিগকে আরো বেশি করিয়া সীতাকে বুঝাইতে বলিয়া চলিয়া গেল।

 রাবণ গেলে পরে রাক্ষসীরা আসিয়া সীতাকে বকিতে লাগিল। একজন বলিল, ‘তোমার মতন এত বোকা ত দেখি নাই। এমন রাজা রাবণ, তাহাকে তুমি ভালবাসিতে চাহ না!’ আর-একজন বলিল, ‘আমার কথা শোন, তোমার জেদ ছাড়িয়া দাও। তাহা হইলে তুমি সকলের রাণী হইবে।’ বিকটা বলিল, ‘তুই অভাগী রাবণকে কেন ভালবাসিবি না।’ দুর্মুখী বলিল, ‘আমাদের কথা রাখ্, নহিলে তোকে মারিয়া ফেলিব।’

 কিন্তু সীতা ইহাদের কোন কথাতেই কান দিলেন না। তাহা দেখিয়া রাক্ষসীরা নিজ-নিজ ঠোঁট চাটিতে চাটিতে কুড়াল লইয়া তাঁহাকে ভয় দেখাইতে লাগিল। নিম্নোদরী বলিল, ‘তোকে খাইব!’ চন্দ্রোদরী বলিল, ‘এটাকে মারিয়া ইহার যকৃত প্লীহা ও বুক সব চিবাইয়া খাইব!’

 এইরূপ করিয়া রাক্ষসীরা সীতাকে মারিয়া খাইবার পরামর্শ করিতে লাগিল। তাহা শুনিয়া সীতা বলিলেন, ‘তোমরা আমাকে মারিয়া খাইয়া ফেল। আমার বাঁচিয়া কি কাজ?’ রাক্ষসীরা বলিল, ‘আর দুই মাস থাক্, তারপর তোর মাংস ছিঁড়িয়া খাইব।’