পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৭৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

করিতেছি তথাপি তুমি কেন আমাকে এমন কঠিন কথা বলিতেছ? যে পাণ্ডবেরা খাণ্ডবদাহ করিল, নিবাত কবচগণকে মারিল, তোমাকে গন্ধর্বের হাত হইতে বাঁচাইল, বিরাটনগরে তোমাদিগকে হারাইয়া গরু ছাড়াইয়া নিল, আর তোমাদের পোশাক লইয়া উত্তরাকে পুতুল খেলিতে দিল, তাহারা যে অসাধারণ বীর ইহা কি বুঝিতে পার না? যাহা হউক, কাল আমি এমন যুদ্ধ করিব যে লোকে চিরদিন সেই যুদ্ধের কথা বলিবে।”

 পরদিন যুদ্ধ বড়ই ভয়ানক হইল। সকালবেলায় দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র আর অভিমন্যুকে মারিতে আসিয়া বাক্ষস অলম্বুষ খুব জব্দ হয়। তারপর দ্রোণ, অর্জুন, সাত্যকি, অশ্বথামা প্রভৃতি অনেকক্ষণ যুদ্ধ করেন। মধ্যাহ্নকাল হইতে যুদ্ধক্রমেই ঘোরতর হইয়া উঠিতে লাগিল। অর্জুন তখন এমন যুদ্ধ করিয়াছিলেন যে কৌরব সৈন্যেরা পলাইবারও অবসর পায় নাই।

 কিন্তু শেষবেলায় একেলা ভীষ্ম পাণ্ডবদিগকে একেবারে অস্থির করিয়া তুলিলেন। কাহার এমন ক্ষমতা হইল না যে তাহাকে আটকায়। ভীষ্মের ধনুষ্টঙ্কার অন্যসকল শব্দকে ডুবাইয়া দিল। তাহার বাণ যাহার গায়ে লাগিল, তাহাকে ভেদ না করিয়া ছাড়ল না। পাণ্ডব সৈন্যেরা অস্ত্র ফেলিয়া এলোচুলে চ্যাঁচাইয়া পলাইতে লাগিল;কাহার সাধ্য তাহাদিগকে ফিরায়। কৃষ্ণ ক্রমাগত অর্জুনকে বলিতেছে, “অর্জুন, কি দেখিতেছ? ভীষ্মকে মার!”

 অর্জুন বলিলেন, “রাজ্যের জন্য যদি এমন কাজই করিতে হয়, তবে আর বনে গিয়া ক্লেশ পাইলাম কেন? আচ্ছা চলুন আপনার কথাই রাখিতেছি।”

 কিন্তু অর্জুন কিছুতেই ভীষ্মকে বারণ করিতে পারিলেন না। তাহা দেখিয়া কৃষ্ণ চাবুক হাতে নিজেই ভীষ্মকে মারিতে চলিলেন। ইহাতে অর্জুন লজ্জিত হইয়া আরো উৎসাহের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন বটে, কিন্তু তাহাতে ভীষ্মের তেজ কমা দূরে থাকুক, বোধ হইল যেন আরো বাড়িয়া গিয়াছে। আগুন লাগিলে উলুবনের যেমন দশা হয়, ভীষ্মের হাতে পড়িয়া পাণ্ডব সৈন্যদেরও প্রায় তেমনি হইল।

 যতক্ষণ আলো ছিল, ততক্ষণ ভীষ্ম এইরূপ করিয়া যুদ্ধ করেন। তারপর অন্ধকার আসিয়া সৈন্যদিগকে বাঁচাইয়া দিল।

 সেরাত্রে পাণ্ডবেরা ভীষ্মের নিকট গিয়া, তাহাকে প্রণামপূর্বক কাতরভাবে বলিলেন, “দাদামহাশয়! আমরা তো কিছুতেই আপনার সঙ্গে পারিয়া উঠিতেছি না। আমাদের রাজ্য পাওয়ার কি উপায় হইবে? আর এত লোক যে মরিতেছে, তাহাই বা কিরূপে বারণ হইবে? আপনাকে বধ করিবার উপায় বলিয়া দিন।”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আমার হাতে অস্ত্র থাকিলে দেবতারাও আমাকে পরাজয় করিতে পারে না। আমি অস্ত্র ত্যাগ করিলে আমাকে মারা সম্ভব হইতে পারে। সুতরাং এক উপায় বলিয়া দিই। শিখণ্ডীকে দেখিলে আমি অস্ত্র ত্যাগ করি, অর্জুন এই শিখণ্ডীকে সম্মুখে রাখিয়া আমার গায় বাণ মারুক। এই আমার বধের উপায়; আমি অনুমতি দিতেছি তোমরা মনের সুখে আমায় প্রহার কর। আমার এই কথামত কাজ করিলে, নিশ্চয় তোমাদের জয়লাভ হইবে।”

 এইরূপ কথাবার্তার পর পাণ্ডবেরা সেখান হইতে চলিয়া আসিলেন। শিবিরে আসিয়া অর্জুন কৃষ্ণকে বলিলেন, “ছেলেবেলায় খেলা করিতে করিতে, ধুলাসুদ্ধ দাদামহাশয়কে জড়াইয়া ধরিয়া তাহার গায়ে ধূলা মাখাইয়া দিতাম। কোলে উঠিয়া ডাকিতাম, বাবা। তিনি