পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫১০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

পিপাসা আর পরিশ্রমে তিনি অতিশয় অস্থির ছিলেন, তাহার উপর আবার মুনিকে বার বার জিজ্ঞাসা করিয়াও তিনি কোন উত্তর পাইলেন না। সুতরাং তখন তাহার রাগ হইবে, ইহা আশ্চর্য কি? তাই তিনি ধনুর আগায় করিয়া একটি মরা সাপ আনিয়া মুনির গলায় জড়াইয়া দিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মুনি ইহাতে কিছুমাত্র রাগ করিলেন না। আর মৌনব্রতে থাকার দরুণ, তিনি রাজাকে কিছু বলিতেও পারিলেন না।

 মুনি রাগ করিলেন না দেখিয়া, বাজারও রাগ চলিয়া গেল। তখন তিনি দুঃখের সহিত রাজধানীতে ফিরিয়া আসিলেন।

 আসিবার সময় রাজা যদি সাপটি ফেলিয়া দিয়া মুনির নিকট ক্ষমা চাহিতেন, কি অন্তত দুটি মিষ্ট কথাও তাঁহাকে বলিতেন, তবে বড়ই ভাল হইত। কিন্তু তিনি তাহার কিছুই করিলেন না। মুনি সেই অবস্থাতেই রহিয়া গেলেন।

 সেই মুনির নাম ছিল শমীক। তিনি অতি মহাশয় পুরুষ ছিলেন, তাহা ইহাতেই বুঝা যাইতেছে যে, এমন অপমান পাইয়াও তিনি পরীক্ষিৎকে শাপ দেন নাই। পরীক্ষিৎকে তিনি খুব ধার্মিক রাজা বলিয়া জানিতেন। তাই তিনি তাঁহাকে ক্ষমা করিলেন।

 কিন্তু শমীকের পুত্র শৃঙ্গী এত সহজ লোক ছিলেন না। এই ঘটনার সময়ে শৃঙ্গী তপস্যা করিতে গিয়াছিলেন। ফিরিয়া আসিবার সময় কৃশ নামক এক ঋষিপুত্রের সহিত তাঁহার দেখা হইল। কৃশ শৃঙ্গীকে দেখিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “শৃঙ্গী, তোমার পিতার গলায় মরা সাপ জড়ান রহিয়াছে, আর তুমি ত দেখিতেছি তপস্বী বলিয়া বড়ই বাহাদুরি করিয়া বেড়াইতেছ।”

 পিতার এইরূপ অপমানের কথা শুনিয়া শৃঙ্গীর মনে বড়ই ক্লেশ হইল তিনি কৃশকে বিনয় করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কৃশ, পিতার এমন অপমান কি করিয়া হইল?”

 কৃশ বলিলেন, “রাজা পরীক্ষিৎ তোমার পিতার গলায় মরা সাপ দিয়া গিয়াছেন।”

 এ কথায় শৃঙ্গী রাগে দুইচোখ লাল করিয়া বলিলেন, “আমার পিতা সেই দুষ্ট রাজার কি করিয়াছিলেন, সত্য করিয়া বল। আজ তোমাকে আমার তপস্যার বল দেখাইতেছি।”

 কৃশ তখন সকল কথাই খুলিয়া বলিলেন। তাহা শুনিয়া শৃঙ্গী রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে পরীক্ষিৎকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “যে দুষ্ট আমার পিতার গলায় মরা সাপ দিয়াছে, আজ হইতে সাত দিনের মধ্যে, তক্ষকের (একটা ভযানক সাপ) কামড়ে তাহার মৃত্যু হইবে।”

 এই বলিয়া শৃঙ্গী তাঁহার পিতার নিকট গিয়া দেখিলেন, সত্য সত্যই তাঁহার গলায় একটা মরা সাপ জড়ান রহিয়াছে। তখন তিনি কাদিতে কাঁদিতে তাঁহাকে বলিলেন, “বাবা দুরাত্মা পরীক্ষিৎ বিনা অপরাধে আপনার এমন অপমান করিল। তাই আমি তাহাকে শাপ দিয়াছি যে, সাত দিনের ভিতরে তাহাকে তক্ষকে খাইবে।”

 শৃঙ্গীর কথায় শমীক নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বলিলেন, “বৎস, তুমি রাজাকে শাপ দিয়া বড় অন্যায় কাজ করিয়াছ। এমন ধার্মিক রাজা একটা অন্যায় কাজ করিয়া ফেলিলেও তাহার অনিষ্ট করা উচিত নহে। আর আমরা হইতেছি তপস্বী, ক্ষমা করাই আমাদের ধর্ম। ক্রোধ করিলে ধর্মের হানি হয়। আমার মৌনব্রতের কথা জানিলে, রাজা কখনই এমন কাজ করিতেন না। আমরা তাঁহার আশ্রয়ে সুখে বাস করিয়া কত পুণ্য উপার্জন করিতেছি, এমন লোককে কি শাপ দিতে হয়?”