পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৩২
গল্পগুচ্ছ

নিজেই নিতে রাজি আছি। আজকাল বিদ্যাশিক্ষার যে-সকল নতুন প্রণালী বেরিয়েছে তার কতক কতক ওকে বােঝাবার চেষ্টা করলাম। অনিলা হাঁ’ও বললে না, না’ও বললে না। এতদিন পরে আমার প্রথম সন্দেহ হল, অনিলা আমাকে শ্রদ্ধা করে না। আমি কলেজে পাস করি নি, সেইজন্য সম্ভবত ও মনে করে, পড়াশুনাে সম্বন্ধে পরামর্শ দেবার ক্ষমতা এবং অধিকার আমার নেই। এতদিন ওকে সৌজাত্য অভিব্যক্তিবাদ এবং রেডিয়াে-চাঞ্চল্য সম্বন্ধে যা-কিছু বলেছি নিশ্চয়ই অনিলা তার মূল্য কিছুই বােঝে নি। ও হয়তাে মনে করেছে, সেকেণ্ড ক্লাসের ছেলেও এর চেয়ে বেশি জানে। কেননা, মাস্টারের হাতের কান-মলার প্যাঁচে প্যাঁচে বিদ্যেগুলাে আঁট হয়ে তাদের মনের মধ্যে বসে গেছে। রাগ করে মনে মনে বললাম, মেয়েদের কাছে নিজের যােগ্যতা প্রমাণ করবার আশা সে যেন ছাড়ে বিদ্যাবুদ্ধিই যার প্রধান সম্পদ।

 সংসারে অধিকাংশ বড়াে বড়াে জীবননাট্য যবনিকার আড়ালেই জমতে থাকে, পঞ্চমাঙ্কের শেষে সেই যবনিকা হঠাৎ উঠে যায়। আমি যখন আমার দ্বৈতদের নিয়ে বের্গ্‌সঁর তত্ত্বজ্ঞান ও ইব্‌সেনের মনস্তত্ত্ব আলােচনা করছি তখন মনে করেছিলুম, অনিলার জীবনযজ্ঞবেদীতে কোনাে আগুনেই বুঝি জ্বলে নি। কিন্তু, আজকে যখন সেই অতীতের দিকে পিছন ফিরে দেখি তখন স্পষ্ট দেখতে পাই, যে সষ্টিকর্তা আগুনে পুড়িয়ে, হাতুড়ি পিটিয়ে, জীবনের প্রতিমা তৈরি করে থাকেন, অনিলার মর্মস্থলে তিনি খুবই সজাগ ছিলেন। সেখানে একটি ছােটো ভাই একটি দিদি এবং একটি বিমাতার সমাবেশে নিয়তই একটা ঘাতপ্রতিঘাতের লীলা চলছিল। পুরাণের বাসুকি যে পৌরাণিক পথিবীকে ধরে আছে সে পথিবী স্থির। কিন্তু, সংসারে যে মেয়েকে বেদনার পৃথিবী বহন করতে হয় তার সে পথিবী মুহূর্তে মুহূর্তে নূতন নূতন আঘাতে তৈরি হয়ে উঠছে। সেই চলতি ব্যথার ভার বুকে নিয়ে যাকে ঘরকন্নার খুঁটিনাটির মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন চলতে হয় তার অন্তরের কথা অন্তর্যামী ছাড়া কে সম্পূর্ণ বুঝবে। অন্তত, আমি তাে কিছুই বুঝি নি। কত উদ্‌বেগ, কত অপমানিত প্রয়াস, পীড়িত স্নেহের কত অন্তর্গূঢ় ব্যাকুলতা, আমার এত কাছে নিঃশব্দতার অন্তরালে মথিত হয়ে উঠছিল আমি তা জানিই নি। আমি জানতুম, যেদিন দ্বৈতদলের ভােজের বার উপস্থিত হত সেইদিনকার উদ্যোগপর্বই অনিলার জীবনের প্রধান পর্ব। আজ বেশ বুঝতে পারছি, পরম ব্যথার ভিতর দিয়েই এ সংসারে এই ছােটো ভাইটিই দিদির সব চেয়ে অন্তরতম হয়ে উঠেছিল। সরােজকে মানুষ করে তােলা সম্বন্ধে আমার পরামর্শ ও সহায়তা এরা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক বলে উপেক্ষা করাতে আমি ও দিকটাতে একেবারে তাকাই নি, তার যে কিরকম চলছে সে কথা কোনােদিন জিজ্ঞাসাও করি নি।

 ইতিমধ্যে আমাদের গলির পয়লা-নম্বর বাড়িতে লােক এল। এ বাড়িটি সেকালের বিখ্যাত ধনী মহাজন উদ্ধব বড়ালের আমলে তৈরি। তার পরে দুই পুরুষের মধ্যে সে বংশের ধন জন প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে, দুটি-একটি বিধবা বাকি আছে। তারা এখানে থাকে না, তাই বাড়িটা পােড়াে অবস্থাতেই আছে। মাঝে মাঝে বিবাহ প্রভৃতি ক্রিয়াকাণ্ডে এ বাড়ি কেউ কেউ অল্প দিনের জন্যে ভাড়া নিয়ে থাকে, বাকি সময়টা এত বড়াে বাড়ির ভাড়াটে প্রায় জোটে না। এবারে এলেন, মনে করাে, তাঁর নাম রাজা সিতাংশুমৌলি, এবং ধরে নেওয়া যাক তিনি নরােত্তমপুরের জমিদার।