পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৮ গল্পগুচ্ছ জীবিত ও মত প্রথম পরিচ্ছেদ রানীহাটের জমিদার শারদাশংকরবাবদের বাড়ির বিধবা বধটির পিতৃকুলে কেহ ছিল না; সকলেই একে একে মারা গিয়াছে। পতিকুলেও ঠিক আপনার বলিতে কেহ নাই, পতিও নাই পত্রও নাই। একটি ভাশরেপো, শারদাশংকরের ছোটো ছেলেটি, সেই তাহার চক্ষের মণি । সে জন্মিবার পর তাহার মাতার বহুকাল ধরিয়া শক্ত পীড়া হইয়াছিল, সেইজন্য এই বিধবা কাকি কাদম্বিনীই তাহাকে মানুষ করিযাছে। পরের ছেলে মানুষ করিলে তাহার প্রতি প্রাণের টান আরও যেন বেশি হয়, কারণ তাহার উপরে অধিকার থাকে না; তাহার উপরে কোনো সামাজিক দাবি নাই, কেবল নেহের দাবি– কিন্তু কেবলমাত্র স্নেহ সমাজের সমক্ষে আপনার দাবি কোনো দলিল-আনসারে সপ্রমাণ করিতে পারে না এবং চাহেও না, কেবল অনিশ্চিত প্রাণের ধনটিকে দ্বিগুণ ব্যাকুলতার সহিত ভালোবাসে । বিধবার সমস্ত রন্ধ প্রীতি এই ছেলেটির প্রতি সিঞ্চন করিষা একদিন শ্রাবণের রাত্রে কাদম্বিনীর অকস্মাৎ মৃত্যু হইল। হঠাৎ কী কারণে তাহার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হইয়া গেল— সময় জগতের আর-সবত্রই চলিতে লাগিল, কেবল সেই মেহকাতর ক্ষুদ্র কোমল বক্ষটির ভিতর সময়ের ঘড়ির কল চিরকালের মতো বন্ধ হইযা গেল । পাছে পলিসের উপদ্রব ঘটে, এইজন্য অধিক আড়ম্বর না করিযা জমিদারের চারিজন ব্রাহরণ কর্মচারী অনতিবিলবে মৃতদেহ দাহ করিতে লইয়া গেল । রানীহাটের মশান লোকালয় হইতে বহন দরে। পাকরিণীর ধারে একখানি কুটির এবং তাহার নিকটে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ, বহৎ মাঠে আর-কাথাও কিছু নাই। পবে: এইখান দিয়া নদী বহিত, এখন নদী একেবারে শুকাইয়া গেছে। সেই শতক জলপথের এক অংশ খনন করিয়া মশানের পকেরিণী নিমিত হইয়াছে। এখনকার লোকেরা এই পাকরিণীকেই পণ্য স্রোতস্বিনীর প্রতিনিধিস্বরুপ জ্ঞান বলে । মতদেহ কুটিরের মধ্যে পথাপন করিয়া চিতাব কঠ আসার প্রতীক্ষায় চাবজনে বসিয়া রহিল । সময় এত দীঘ বোধ হইতে লাগিল যে, অধীল হইয়া চারিজনেল মধ্যে নিতাই এবং গরচরণ কাঠ আনিতে এত বিলম্ব হইতেছে কেন দেখি গৈল বধ এবং বনমালী মতদেহ রক্ষা করিয়া বসিয়া রহিল। শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রি। থমথমে মেঘ করিয়া আছে, আকাশে একটি তারা দেখা যায় না; অন্ধকার ঘরে দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া বহিল। একজনের চাদরে দিয়াশলাই এবং বাতি বাঁধা ছিল। বর্ষাকালের দিয়াশলাই বহ চোটাতেও জলিল না-– যে লণ্ঠন সঙ্গে ছিল তাহাও নিবিয়া গেছে। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া একজন কহিল, “ভাই রে, এক ছিলিম তামাকের জোগাড় থাকিলে বড়ো সুবিধা হইত। তাড়াতাডিতে কিছুই আনা হয় নাই।" অন্য ব্যক্তি কহিল, “আমি চট কবিয়া এক দৌড়ে সমস্ত সংগ্ৰহ করিয়া আনিতে পারি।” বনমালীর পলায়নের অভিপ্রায় ববিয়া বিধ কহিল, "মাইরি। আর, আমি বাকি