পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মণিহারা 8Oළු শব্দটা ক্ৰমে ঘাটের সবোচ্চ সোপানতল ছাড়িয়া বাড়ির দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল । বাড়ির সম্মখে আসিয়া থামিল। দেউড়ি বন্ধ করিয়া দরোয়ান যাত্রা শুনিতে গিয়াছিল। তখন সেই রাখবোরের উপর ঠকঠক ঝমঝেম করিয়া ঘা পড়িতে লাগিল, যেন অলংকারের সঙ্গে সঙ্গে একটা শক্ত জিনিস বারের উপর আসিয়া পড়িতেছে। ফণিভূষণ আর থাকিতে পারিল না। নিবাণদীপ কক্ষগুলি পার হইয়া অন্ধকার সিড়ি দিয়া নামিয়া রন্ধদ্বারের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। বার বাহির হইতে তালাবন্ধ ছিল। ফণিভূষণ প্রাণপণে দুই হাতে সেই বার নাড়া দিতেই সেই সংঘাতে এবং তাহার শব্দে চমকিয়া জাগিয়া উঠিল। দেখিতে পাইল, সে নিদ্রিত অবস্থার উপর হইতে নীচে নামিয়া আসিয়াছিল। তাহার সব শরীর ঘমান্ত, হাত পা বরফের মতো ঠাণ্ডা এবং হৎপিণ্ড নিবাণোন্মুখ প্রদীপের মতো সফারিত হইতেছে। স্বপ্ন ভাঙিয়া দেখিল, বাহিরে আর কোনো শব্দ নাই, কেবল শ্রাবণের ধারা তখনও ঝরকের শব্দে পড়িতেছিল এবং তাহারই সহিত মিশ্রিত হইয়া শনা যাইতেছিল যাত্রার ছেলেরা ভোরের সরে তান ধরিয়াছে । যদিচ ব্যাপারটা সমস্তই স্বপ্ন কিন্তু এত অধিক নিকটবতী এবং সত্যবং যে ফণিভূষণের মনে হইল, যেন অতি অল্পের জন্যই সে তাহার অসম্ভব আকাঙ্ক্ষার আশচয সফলতা হইতে বঞ্চিত হইল। সেই জলপতনশব্দের সহিত দরোগত ভৈরবীর তান তাহাকে বলিতে লাগিল, এই জাগরণই স্বপ্ন, এই জগৎই মিথ্যা। তাহার পরদিনেও যাত্রা ছিল এবং দরোয়ানেরও ছয়টি ছিল। ফণিভূষণ হুকুম দিল, অজ্ঞ সমস্ত রান্তি যেন দেউড়ির দরজা খোলা থাকে। দরোয়ান কহিল, মেলা উপলক্ষে নানা দেশ হইতে নানা প্রকারের লোক আসিয়াছে, দরজা খোলা রাখিতে সাহস হয় না। ফণিভূষণ সে কথা মানিল না। দরোয়ান কহিল, তবে আমি সমস্ত রান্তি হাজির থাকিয়া পাহারা দিব।' ফণিভূষণ কহিল, সে হইবে না, তোমাকে যাত্রা শুনিতে যাইতেই হইবে।” দরোয়ান আশ্চর্য হইয়া গেল। পরদিন সন্ধ্যাবেলায় দীপ নিভাইরা দিয়া ফণিভূষণ তাহার শয়নকক্ষের সেই বাতায়নে আসিয়া বসিল। আকাশে অবটিসংরক্ষভ মেঘ এবং চতুদিকে কোনো-একটি অনিদিষ্ট আসন্নপ্রতীক্ষার নিস্তব্ধতা। ভেকের অশ্রাত কলরব এবং যাত্রার গানের চীৎকারধনি সেই স্তখত ভাঙিতে পারে নাই, কেবল তাহার মধ্যে একটা অসংগত অদ্ভুতরস বিস্তার করিতেছিল। অনেকরাত্রে এক সময়ে ভেক এবং ঝিল্লি এবং যাত্রার দলের ছেলেরা চুপ করিয়া গেল এবং রাত্রের অন্ধকারের উপরে আরও একটা কিসের অন্ধকার আসিয়া পড়িল । বাঝা গেল, এইবার সময় আসিয়াছে । পাবদিনের মতো নদীর ঘাটে একটা ঠকঠক এবং কম্যকম শব্দ উঠিল। কিন্তু ফণিভূষণ সে দিকে চোখ ফিরাইল না। তাহার ভয় হইল, পাছে অধীর ইচ্ছা এবং অশান্ত চেষ্টায় তাহার সকল ইচ্ছা, সকল চেষ্টা বাথ হইয়া যায়। পাছে আগ্রহের বেগ তাহার ইন্দ্রিরশক্তিকে অভিভূত করিয়া ফেলে। সে আপনার সকল চেষ্টা নিজের মনকে দমন করিবার জন্য প্রয়োগ করিল, কাঠের মতি’র মতো শক্ত হইয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। h শিজিত শব্দ আজ ঘাট হইতে ক্ৰমে ক্ৰমে অগ্রসর হইয়া মন্তবারের মধ্যে প্রবেশ