পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যজ্ঞেশ্বরের বজ্ঞ 886; পড়িতেছে। বৈশাখ মাসে যে এমন শ্রাবপধারা বহিবে তাহা তিনি বনেও আশঙ্কা করেন নাই। গন্ডগ্রামের ভদ্র অভদ্র সমস্ত লোকই যজ্ঞেশবরকে সাহায্য করিতে উপস্থিত হইয়াছিল; সংকীর্ণ পথানকে তাহারা আরও সংকীর্ণ করিয়া তুলিল এবং বটির কল্লোলের উপর তাহাদের কলরব যোগ হইয়া একটা সমুদ্রমন্থনের মতো গোলমালের উৎপত্তি হইল। পল্লীবদ্ধগণ ধনী অতিথিদের সম্মাননার উপযন্ত উপায় না দেখিয়া যাহাকে-তাহাকে ক্ৰমাগতই জোড়হন্তে বিনয় করিয়া বেড়াইতে লাগিল । বরকে যখন অন্তঃপরে লইয়া গেল তখন কন্ধ বরযাত্রীর দল রব তুলিল, তাহাদের ক্ষুধা পাইয়াছে, আহার চাই। মুখ পাংশবেণ করিয়া যজ্ঞেশ্বর গলায় কাপড় দিয়া সকলকে বলিলেন, “আমার সাধ্যমত যাহা-কিছর আয়োজন করিয়াছিলাম সব জলে ভাসিয়া গেছে ।" দুব্যসামগ্রী কতক পাবনা হইতে পথের মধ্যে কতক-বা ভগ্নপ্রায় পাকশালায় গলিয়া গালিয়া উনান নিবিয়া একাকার হইয়া গেছে। সহসা উপযন্ত পরিমাণ আহায্য সংগ্ৰহ করা যাইতে পারে বড়াশিবতলা এমন গ্রামই নহে । গৌরসন্দর যজ্ঞেশ্বরের দগতিতে খুশি হইলেন। কহিলেন, “এতগলা মানষেকে তো অনাহারে রাখা যায় না, কিছত্ৰ তো উপায় করিতে হইবে।” বরযাত্রগণ খেপিয়া উঠিয়া মহা হাঙ্গামা করিতে লাগিল। কহিল, “আমরা স্টেশনে গিয়া ট্রেন ধরিয়া এখনই বাড়ি ফিরিয়া যাই।” যজ্ঞেশ্বর হাত জোড় করিয়া কহিলেন, “একেবারে উপবাস নয়। শিবতলার ছানা বিখ্যাত । উপযুক্ত পরিমাণে ছানা কদমা সংগ্রহ আছে । আমার অন্তরের মধ্যে যাহা হইতেছে তাহা অন্তর্যাম7ই জানেন ।” যজ্ঞেশবরের দগেতি দেখিয়া বাথানপাড়ার গোয়ালারা বলিয়াছিল, “ভয় কী ঠাকুর, ছানা যিনি যত খাইতে পারেন আমরা জোগাইয়া দিব।” বিদেশের বরযায়ীগণ না খাইয়া ফিরিলে শিবতলা গ্রামের অপমান ; সেই অপমান ঠেকাইবার জন্য গোয়ালারা প্রচুর ছানার বন্দোবশত করিয়াছে । বরযাত্ৰগণ পরমশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “যত আবশ্যক ছানা জোগাইতে পারিবে তো ?” যজ্ঞেশ্বর কথঞ্চিৎ আশান্বিত হইয়া কহিল, “তা পারিব।” “আচ্ছা, তবে আনো” বলিয়া বরযাত্ৰগণ বসিয়া গেল। গৌরসন্দর বসিলেন না, তিনি নীরবে এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া কৌতুক দেখিতে লাগিলেন। আহারস্থানের চারি দিকেই পকেরিণী ভরিয়া উঠিয়া জলে কাদায় একাকার হইয়া গৈছে । যজ্ঞেশ্বর যেমন-যেমন পাতে ছানা দিয়া যাইতে লাগিলেন তৎক্ষণাৎ বরষারগণ তাহা কাঁধ ডিঙাইয়া পশ্চাতে কাদার মধ্যে টপ টপ করিয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল। উপায়বিহীন যজ্ঞেশবরের চক্ষ জলে ভাসিয়া গেল। বারবার সকলের কাছে জোড়হাত করিতে লাগিলেন; কহিলেন, “আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, আপনাদের নিষাতনের যোগ্য নই।” একজন শকেহাস্য হাসিয়া উত্তর করিল, “মেয়ের বাপ তো বটেন, সে অপরাধ যায় কোথায়।” যজ্ঞেশ্বরের বামের বন্ধগণ বারবার ধিক্কায় করিয়া বলিতে লাগিল, "তোমার যেমন অবস্থা সেইমত ঘরে কন্যাদান করিলেই এ দৃশ্নতি ঘটিত না।” ২৯