পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে লইবে— ভর্ৎসনার অংশ অসংকোচে গ্রহণ করিবে, বর্মের স্বরূপ হইয়া ললিতাকে সমস্ত আঘাত হইতে বাঁচাইতে চেষ্টা করিবে।

 কিন্তু ললিতার ঠিক মনের ভাবটা বিনয় বুঝিতে পারে নাই। সে যে ভর্ৎসনার প্রতিরোধক-স্বরূপেই বিনয়কে ছাড়িতে চাহিল না তাহা নহে। আসল কথা, ললিতা কিছুই চাপা দিয়া রাখিতে পারে না। সে যাহা করিয়াছে তাহার সমস্ত অংশই পরেশবাবু চক্ষে দেখিবেন এবং বিচারে যে ফল হয় তাহার সমস্তটাই ললিতা গ্রহণ করিবে এইরূপ তাহার ভাব।

 আজ সকাল হইতেই ললিতা বিনয়ের উপর মনে মনে রাগ করিয়া আছে। রাগটা যে অসংগত তাহা সে সম্পূর্ণ জানে— কিন্তু অসংগত বলিয়াই রাগটা কমে না বরং বাড়ে।

 স্টীমারে যতক্ষণ ছিল ললিতার মনের ভাব অন্যরূপ ছিল। ছেলেবেলা হইতে সে কখনো রাগ করিয়া কখনো জেদ করিয়া একটা-না-একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটাইয়া আসিয়াছে, কিন্তু এবারকার ব্যাপারটি গুরুতর। এই নিষিদ্ধ ব্যাপারে বিনয়ও তাহার সঙ্গে জড়িত হইয়া পড়াতে সে এক দিকে সংকোচ এবং অন্য দিকে একটা নিগূঢ় হর্ষ অনুভব করিতেছিল। এই হর্ষ যেন নিষেধের সংঘাত-দ্বারাই বেশি করিয়া মথিত হইয়া উঠিতেছিল। একজন বাহিরের পুরুষকে সে আজ এমন করিয়া আশ্রয় করিয়াছে, তাহার এত কাছে আসিয়াছে, তাহাদের মাঝখানে আত্মীয়সমাজের কোনো আড়াল নাই, ইহাতে কতখানি কুণ্ঠার কারণ ছিল— কিন্তু বিনয়ের স্বাভাবিক ভদ্রতা এমনি সংযমের সহিত একটি আবরু রচনা করিয়া রাখিয়াছিল যে এই আশঙ্কাজনক অবস্থার মাঝখানে বিনয়ের সুকুমার শীলতার পরিচয় ললিতাকে ভারি একটা আনন্দ দান করিতেছিল। যে বিনয় তাহাদের বাড়িতে সকলের সঙ্গে সর্বদা আমোদ-কৌতুক করিত, যাহার কথার বিরাম ছিল না, বাড়ির ভৃত্যদের সঙ্গেও যাহার আত্মীয়তা অবারিত, এ সে বিনয় নহে। সতর্কতার দোহাই দিয়া যেখানে সে অনায়াসেই ললিতার সঙ্গ বেশি করিয়া লইতে পারিত সেখানে বিনয় এমন দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিয়াছিল যে,

২৪৮