পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 পরেশ একটু হাসিলেন, এ কথা লইয়া কোনো তর্কে প্রবৃত্ত হইলেন না। তিনি কহিলেন, “আমাদের সমাজে এ বিবাহে কেউ যোগ দেবে না; বিনয়ের আত্মীয়েরাও কেউ আসবেন না শুনছি। আমার কন্যার দিকে একমাত্র কেবল আমি আছি- বিনয়ের দিকে বোধ হয় তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, এই জন্য এ সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছি।”

 গোরা মাথা নাড়িয়া কহিল, “এ সম্বন্ধে আমার সঙ্গে পরামর্শ কী করে হবে? আমি তো এর মধ্যে নেই।”

 পরেশ বিস্মিত হইয়া গোরার মুখের দিকে ক্ষণকাল দৃষ্টি রাখিয়া কহিলেন, “তুমি নেই!”

 পরেশের এই বিস্ময়ে গোরা মুহূর্তকালের জন্য একটা সংকোচ অনুভব করিল। সংকোচ অনুভব করিল বলিয়াই পরক্ষণে দ্বিগুণ দৃঢ়তার সহিত কহিল, “আমি এর মধ্যে কেমন করে থাকব!”

 পরেশবাবু কহিলেন, “আমি জানি তুমি তার বন্ধু- বন্ধুর প্রয়োজন এখনই কি সব চেয়ে বেশি নয়?”

 গোরা কহিল, “আমি তার বন্ধু, কিন্তু সেইটেই তো সংসারে আমার একমাত্র বন্ধন এবং সকলের চেয়ে বড় বন্ধন নয়।”

 পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “গৌর, তুমি কি মনে কর বিনয়ের আচরণে কোনো অন্যায় অধর্ম প্রকাশ পাচ্ছে?”

 গোরা কহিল, “ধর্মের দুটো দিক আছে যে। একটা নিত্য দিক, আরএকটা লৌকিক দিক। ধর্ম যেখানে সমাজের নিয়মে প্রকাশ পাচ্ছেন সেখানেও তাঁকে অবহেলা করতে পারা যায় না; তা করলে সংসার ছারখার হয়ে যায়।”

 পরেশবাবু কহিলেন, “নিয়ম তো অসংখ্য আছে, কিন্তু সকল নিয়মেই যে ধর্ম প্রকাশ পাচ্ছেন এটা কি নিশ্চিত ধরে নিতে হবে?”

 পরেশবাবু গোরার এমন একটা জায়গায় ঘা দিলেন যেখানে তাহার মনে আপনিই একটা মন্থন চলিতেছিল এবং সেই মন্থন হইতে যে একটি সিদ্ধান্তও লাভ করিয়াছিল— এই জন্যই তাহার অন্তরে-সঞ্চিত বাক্যের বেগে পরেশবাবুর

৫০৮