পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

না করিয়া তর্কে যোগ দিয়াছিল, নিজের এই প্রগল্‌ভতায় সে যেন মরিয়া যাইতেছিল। হারানের অন্যায় তর্কে একবার যখন সুচরিতা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছিল তখন গোরা তাহার মুখের দিকে চাহিয়াছিল; সে চাহনিতে সংকোচের লেশমাত্র ছিল না— কিন্তু সে চাহনির ভিতর কী ছিল তাহাও বোঝা শক্ত। তখন কি সে মনে মনে বলিতেছিল— এ মেয়েটি কী নির্লজ্জ। অথবা, ইহার অহংকার তো কম নয়, পুরুষমানুষের তর্কে এ অনাহুত যোগ দিতে আসে! তাহাই যদি সে মনে করিয়া থাকে তাহাতে কী আসে যায়। কিছুই আসে যায় না, তবু সুচরিতা অত্যন্ত পীড়া বোধ করিতে লাগিল। এ-সমস্তই ভুলিয়া যাইতে, মুছিয়া ফেলিতে সে একান্ত চেষ্টা করিল, কিন্তু কোনোমতেই পারিল না। গোরার উপর তাহার রাগ হইতে লাগিল— গোরাকে সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন উদ্ধত যুবক বলিয়া সমস্ত মনের সঙ্গে অবজ্ঞা করিতে চাহিল, কিন্তু তবু সেই বিপুলকায় বজ্রকণ্ঠ পুরুষের সেই নিঃসংকোচ দৃষ্টির স্মৃতির সম্মুখে সুচরিতা মনে মনে অত্যন্ত ছোটো হইয়া গেল— কোনোমতেই সে নিজের গৌরব খাড়া করিয়া রাখিতে পারিল না।

 সকলের বিশেষ লক্ষ্যগগাচর হওয়া, আদর পাওয়া, সুচরিতার অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল। সে যে মনে মনে এই আদর চাহিত তাহা নহে, কিন্তু আজ গোরার নিকট হইতে উপেক্ষা কেন তাহার কাছে এত অসহ্য হইল। অনেক ভাবিয়া সুচরিতা শেষকালে স্থির করিল যে, গোরাকে সে বিশেষ করিয়া হার মানাইতে ইচ্ছা করিয়াছিল বলিয়াই তাহার অবিচলিত অনবধান এত করিয়া হৃদয়ে আঘাত করিতেছে।

 এমনি করিয়া নিজের মনখানা লইয়া টানাহেঁড়া করিতে করিতে রাত্রি বাড়িয়া যাইতে লাগিল। বাতি নিবাইয়া দিয়া বাড়ির সকলেই ঘুমাইতে গিয়াছে। সদর-দরজা বন্ধ হইবার শব্দ হইল—বোঝা গেল বেহারা রান্না- খাওয়া সারিয়া এইবার শুইতে যাইবার উপক্রম করিতেছে। এমন সময় ললিতা তাহার রাত্রির কাপড় পরিয়া ছাতে আসি। সুচরিতাকে কিছুই না বলিয়া তাহার পাশ দিয়া গিয়া ছাতের এক কোণে রেলিঙ ধরিয়া

৭৬