পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৩৩

আর বাঁচিব না। আমি আমার মাসিমার মতো পুণ্যবতী নই, তোমাকে আশ্রয় করিয়া আমি রক্ষা পাইব না।”

 এই বলিয়া আশা বার বার বিছানার উপর গড় করিয়া প্রণাম করিল।

 আশার জেঠামশায়ের ফিরিবার সময় হইল। বিদায়ের পূর্বসন্ধ্যায় অন্নপূর্ণা আশাকে আপনার কোলে বসাইয়া কহিলেন, “চুনি, মা আমার, সংসারের শোক দুঃখ অমঙ্গল হইতে তোকে সর্বদা রক্ষা করিবার শক্তি আমার নাই। আমার এই উপদেশ— যেখান থেকে যত কষ্টই পাস, তোর বিশ্বাস, তোর ভক্তি স্থির রাখিস; তোর ধর্ম যেন অটল থাকে।”

 আশা তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া কহিল, “আশীর্বাদ করে মাসিমা, তাই হইবে।”


৩১

আশা ফিরিয়া আসিল। বিনোদিনী তাহার পরে খুব অভিমান করিল—“বালি, এতদিন বিদেশে রহিলে, একখানা চিঠি লিখিতে নাই?”

 আশা কহিল, “তুমিই কোন্ লিখিলে ভাই, বালি।”

 বিনোদিনী। আমি কেন প্রথমে লিখিব। তোমারই তো লিখিবার কথা।

 আশা বিনোদিনীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া নিজের অপরাধ স্বীকার করিয়া লইল। কহিল, “জান তো ভাই, আমি ভালো লিখিতে জানি না। বিশেষ, তোমার মতো পণ্ডিতের কাছে লিখিতে আমার লজ্জা করে।”

 দেখিতে দেখিতে দুইজনের বিবাদ মিটিয়া গিয়া প্রণয় উদবেলিত হইয়া উঠিল।

 বিনোদিনী কহিল, “দিনরাত্রি সঙ্গ দিয়া তোমার স্বামীটির অভ্যাস তুমি একেবারে খারাপ করিয়া দিয়াছ। একটি কেহ কাছে নহিলে থাকিতে পারে না।”

 আশা। সেইজন্যই তো তোমার উপরে ভার দিয়া গিয়াছিলাম। কেমন করিয়া সঙ্গ দিতে হয় আমার চেয়ে তুমি ভালো জান।

 বিনোদিনী। দিনটা তো একরকম করিয়া কলেজে পাঠাইয়া নিশ্চিন্ত হইতাম, কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় কোনোমতেই ছাড়াছুড়ি নাই— গল্প করিতে হইবে, বই পড়িয়া শুনাইতে হইবে, আবদারের শেষ নাই।

 আশা। কেমন জব্দ। লোকের মন ভুলাইতে যখন পার তখন লোকেই বা ছাড়িবে কেন।

 বিনোদিনী। সাবধান থাকিস ভাই! ঠাকুরপো যেরকম বাড়াবাড়ি করেন, এক-একবার সন্দেহ হয়, বুঝি বশ করিবার বিদ্যা জানি বা।