পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬৪
জননী

দোকান থেকে চট করে একটা রুটি নিয়ে আয়,—সকালে উঠে খাই খাই করে সবাই তো খাবে আমায়। কোনদিন বড়বৌ কোলের ছেলেটিকে দিয়া যায়, বলে, দেখো তো ভাই পার নাকি ঘুম পাড়াতে হেঁটে হেঁটে? ডানা আমার ছিঁড়ে গেল। কোনদিন বাড়িওলা স্বয়ং আসেন। দাবার ছক লইয়া বলেন, আয় বনু বসি একদান।—বনুর ভাত ঢাকা দিয়ে রাখো বৌমা, দুধ থাকে তো দিও দিকি বনুকে একটু, দু' হাতাই দিও,—ক্ষীর করে রাখ বাকিটা। কালের মত ঘন কোরো না বাছা ক্ষীর, ঘন ক্ষীর খেয়ে আজ পেট কামড়েছে, পাতলাই রেখো আর চিনি দিও একটু। ভানু, ও ভানু, তামাক দে দিকি মা—বড় কলকেতে দিস বেশি তামাক দিয়ে।

 এসব দেখিয়া শুনিয়া শ্যামার চোখে যদি জল আসিত, সে জল সোজা গিয়া পড়িত বনবিহারীর মাথায় পথের ধূলায় ধূসর রুক্ষ চুলে। এক একদিন বিভা আসিয়া দাঁড়ায়। ঝুঁকিয়া দেখিয়া ফিস ফিস করিয়া বলে, অনেক মানুষ দেখেছি, এমন বোকা কখনো দেখিনি মাসিমা। এমন করে এখানে তোর পড়ে থাকা কেন? মেসে গিয়ে থাকলেই হয়।

 রোজগারপাতি বুঝি নেই।—শ্যামা বলে।

 কুড়ি পঁচিশ ও যা পায় মাসিমা, একজনের পক্ষে তাই ঢের। তা'ছাড়া এমন করে থাকার চেয়ে না খেয়ে মরাও ভাল।—পুরুষমানুষ নয় ও।

 রাগে বিভা গরগর করে। শ্যামা একটু অবাক হয়, এত রাগ কেন বিভার? কোথায় কোন কাপুরুষ যুবক ক্রীতদাসের জীবন যাপন করে খেয়াল করিয়া বিচলিত হওয়ার স্বভাব তো বিভার নয়। হঠাৎ বিভা করে কি, ঝুঁকিয়া ডাক দেয়, বনবাবু, মা আপনাকে ডাকছেন, উপরে আসবেন একবার?

 বনবিহারী মুখ তুলিয়া তাকায়, বলে, যাই।

 সে উঠিয়া আসিলে শ্যামাকে অবাক করিয়া দিয়া বিভা তাহাকে বকে। রীতিমত ধমকায়। বলে, কি যে প্রবৃত্তি আপনার বুঝিনে কিছু, একেবারে আপনার ব্যাক্‌বোন নেই, সারাদিন ঘুরে এত রাত্রে ফিরে এলেন। এখনও আপনাকে সংসারের কাজ করতে হবে? কেন করেন আপনি? আমি হলে তো সবাইকে চুলোয় যেতে বলে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তাম, এত কি আহ্লাদ সকলের! বিনে মাইনের চাকর নাকি আপনি!—এমনি ভাবে কত