পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জোড়াসাঁকোর ধারে
১০৯

ছিল। আর্টেরই শখ তাঁর। জার্মান-যুদ্ধের ঠিক আগে জাহাজ-বোঝাই তাঁর যা কিছু ভালো ভালো জিনিস ও আমাদের আঁকা একপ্রস্থ ছবি বিলেতে পাঠিয়েছিলেন। সেই জাহাজ গেল ডুবে ভূমধ্যসাগরে। তিনি দুঃখ করেছিলেন, ‘আমার আসবাবপত্র সব যায় যাক কোনো দুঃখ নেই, কিন্তু তোমাদের ছবিগুলো যে গেল এইটেই বড় দুঃখের কথা।’ নন্দলাল যখন এসে দুঃখ করলে তাকে স্তোকবাক্য দিয়েছিলুম, ‘ভালোই হয়েছে, এতে দুঃখ কি। আমি দেখছি জলদেবীরা আমাদের ছবিগুলো বরুণালয়ে টাঙিয়ে আনন্দ করছেন। গেছে যাক, ভেবো না।’ সেই লর্ড কারমাইকেল একদিন আমার টেবিলের উপর নিবেদিতার ফোটোখানি দেখে ঝুঁকে পড়লেন, বললেন, ‘এ কার ছবি?’ বললুম, ‘সিস্টার নিবেদিতার।’ তিনি বললেন, ‘এ-ই সিস্টার নিবেদিতা? আমার একখানি এইরকম ছবি চাই।’ বলেই আর বলাকওয়া না, সেই ছবিখানি বগলদাবা করে চলে গেলেন। ছবিখানি থাকলে বুঝতে পারতে সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা কাকে বলে। সাজগোজ ছিল না, পাহাড়ের উপর চাঁদের আলো পড়লে যেমন হয় তেমনি ধীর স্থির মূর্তি তাঁর। তাঁর কাছে গিয়ে কথা কইলে মনে বল পাওয়া যেত।

 বিবেকানন্দকেও দেখেছি। কর্তাদাদামশায়ের কাছে আসতেন। দীপুদার সহপাঠী ছিলেন; ‘কি হে নরেন’ বলে তিনি কথা বলতেন। বিবেকানন্দের বক্তৃতা শোনবার ভাগ্য হয়নি আমার, তার চেহারা দেখেছি; কিন্তু আমার মনে হয় নিবেদিতার কাছে লাগে না। নিবেদিতার কি একটা মহিমা ছিল; কি করে বোঝাই সে কেমন চেহারা। দুটি যে দেখিনে আর, উপমা দেব কি।

 শিল্পের পথে চলতে চলতে ভালো মন্দ জ্ঞানী মূর্খ অনেকের সংস্পর্শেই এসেছি। সইতে হয়েছে অনেক কিছু। বলি এক ঘটনা।

 লাটবন্ধুও আসত যেমন, রাজবন্ধুও আসত অনেক। রবিকা জাপান থেকে ‘অন্ধ ভিখিরী’ ছবি আনলেন; নামকরা শিল্পীর আকা, মস্ত সিল্কে। কি ছবির কারুকাজ, প্রতিটি চুলের কি টান, দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। বিচিত্রা হলে টানানো হল সেই ছবি। এখন এক রাজবন্ধু এসেছেন দেখতে; শিল্পের সমজদার বলে নাম আছে তাঁর। আমার দুর্বুদ্ধি, তাঁকে বোঝাতে গেছি জাপানী শিল্পীর তুলির টানের বাহাদুরি, কি করে একটি টানে একটি চুল এঁকেছে। রাজবন্ধু চোখ বুজে ভাবলেন খানিক, ভেবে বললেন ‘অবনিবাবু, আমি দেখেছি গাড়ির চাকায় যার লাইন টানে তারাও এর চেয়ে সূক্ষ্ম লাইন টানে।’ শুনে আমার একেবারে বাক্‌রোধ। এমন ধাক্কা আমি কখনো খাইনি। দেখেছি