পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পাইলেন। ছুরি দিয়া উপর উপর মূল-শিকড়ের ছাল চাঁচিয়া তুলিতে লাগিলেন।

 অল্পক্ষণের নিমিত্ত চাঁদ অতিকষ্টে যাতনা সহ্য করিলেন, তারপর আর সহিতে পারিলেন না। চাঁদ বলিলেন,— “উঃ! লাগে যে!”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ভয় নাই। এই হইয়া গেল!” তাড়াতাড়ি কঙ্কাবতী চাঁদের মূল-শিকড় হইতে একতোলা পরিমাণ ছাল তুলিয়া লইলেন।

 তখন চাঁদ জিজ্ঞাসা করিলেন,— “আমার শিকড় পুনরায় গড়াইবে তো?”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “গজাইবে বৈ কি! চিরকাল কি আর এমন থাকিবে! ইহার উপর একটু কাদা দিয়া দিও, মন্দ লোকের দৃষ্টি পড়িয়া বিষিয়ে উঠবে না।”

 চাঁদ জিজ্ঞাসা করিলেন,— “যদি ঘা হয়?”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “যদি ঘা হয়, তাহা হইলে ইহার উপর একটু লুচি-ভাজা ঘি দিও।”

 চাঁদ জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তুমি বুঝি মেয়ে ডাক্তার? দাঁতের গোড়ার ঔষধ জান? আমার দাঁতের গোড়া বড় কন-কন করে।”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “আমি মেয়ে ডাক্তার নই। তবে এই বয়সে আমি অনেক দেখিলাম, অনেক শুনিলাম, তাই দুটো-একটা ঔষধ শিখিয়া রাখিয়াছি। তোমার দাঁতের গোড়া আর ভাল হইবে না। লোকের দাঁত কি চিরকাল সমান থাকে? তুমি কতকালের চাঁদ হইলে, মনে করিয়া দেখ দেখি। কবে সেই সমুদ্রের ভিতর হইতে বাহির হইয়াছ। এখন আর ছেলেচাঁদ হইতে সাধ করিলে চলিবে কেন।

 চাঁদ বলিলেন,— “ছেলে-চাঁদ হইতে চাই না। ঘরে আমার অনেকগুলি ছেলে-চাঁদ আছে। আশীর্ব্বাদ কর, তাহারা বাঁচিয়া-বর্ত্তিয়া থাকুক, তাহা হইলে এরপর দেখিতে পাইবে, আকাশে কত চাঁদ হয়! আকাশের চারিদিকে তখন চাঁদ উঠিবে। এখনি আমার ছেলেমেয়েগুলি বলে,— 'বাবা! অমাবস্যার রাত্রিতে তুমি শ্রান্ত হইয়া পড়, সকালবেলা বিছানা হইতে আর উঠিতে পার না। তা যাই না? আমরা গিয়া আকাশেতে উঠি না। আমি তাদের মানা করি! আকাশের একধার হইতে অন্য ধার পর্যন্ত, পথটুকু তো আর কম নয়? তারা ছেলেমানুষ, অত পথ গড়াইতে পারিবে কেন?

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তোমার ছেলেমেয়েগুলি কতবড় হইয়াছে?”

 চাদ উত্তর করিলেন,— “বড়মেয়েটি একখানি কাঁসির মত হইয়াছে। কেমন চচকে কাঁসি! তেঁতুল দিয়া মাজিলেও তোমাদের কাঁসির সেরূপ রং হয় না। মেজছেলেটি একখানি খত্তালের মত হইয়াছে। মাঝে আরও অনেকগুলি ছেলেমেয়ে আছে। কোলের মেয়েটি একটু কালো তোমরা যে সেকালে পাথুরে পোকার টিপ পরিতে, সেই তত বড় হইয়াছে। কিন্তু কালো হউক, মেয়েটির শ্রী আছে। বড় হইলে, এরপর যখন আকাশে কালো চাঁদ উঠিবে, তখন তোমরা বলিবে, হা চটকসুন্দরী বটে! তাহার কালো কিরণে জগতে চক্‌চকে অন্ধকার হইবে, সমুদয় জগৎ যেন বারনিশ চামড়ায় মুড়িয়া যাইবে! তা, যাই হউক, এখন দাঁতের গোড়ার কি হইবে! কিছু যে খাইতে পারি না। ডাঁটা চিবাইতে যে বড় লাগে। ভাল যদি কোনও ঔষধ থাকে, তো আমাকে দিয়া যাও।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “চাদ! তুমি এক কাজ কর! আমার সঙ্গে তুমি চল। তোমার শিকড় পাইয়াছি, পতি আমার এখন ভাল হইবেন। পতি আমার কলিকাতায় থাকেন! কলিকাতায় দন্তকারেরা আছে। তোমার পোকা-ধরা পচা দাঁতগুলি সাড়াশি দিয়া তাহারা তুলিয়া দিবে, নূতন কৃত্রিম দন্ত পরাইয়া দিবে।”

১১৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ