পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পরিষ্কৃত, নানা ধনে পরিপূরিত, নানা সাজে সুসজ্জিত। রজতকাঞ্চনহীরা, মাণিক, মুকুতা চারিদিকে রাশি রাশি স্তূপাকার রহিয়াছে দেখিয়া কঙ্কাবতী মনে মনে অদ্ভূত মানিলেন। অট্টালিকাটি কিন্তু পর্ব্বতের অভ্যন্তরে স্থিত। বাহির হইতে দেখা যায় না। পর্ব্বত-গাত্রে সামান্য একটি নিবিড় অন্ধকারময় সুড়ঙ্গ দ্বারা কেবল ভিতরে প্রবেশ করিতে পারা যায়! পর্ব্বতের শিখরদেশ হইতে অট্টালিকার ভিতর আলোক প্রবেশ করে। কিন্তু আলোক আসিবার পথও এরূপ কৌশলভাবে নিবেশিত ও লুক্কায়িত আছে যে, সে পথ দিয়া ভূচর-খেচর কেহ অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিতে পারে না; অট্টালিকার ভিতর হইতে কেহ যাইতেও পারে না। অট্টালিকার ভিতর, বসন, খাট, পালঙ্ক প্রভৃতি কোনও দ্রব্যের অভাব নাই। নাই কেবল আহারীয় সামগ্রী।

 অট্টালিকার ভিতর উপস্থিত হইয়া ব্যাঘ্র বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! এখন তুমি আমার পৃষ্ঠ হইতে অবতরণ কর। একটুখানি এইখানে বসিয়া থাক, আমি আসিতেছি। কিন্তু সাবধান! এখানকার কোনও দ্রব্যে হাত দিও না, কোন দ্রব্য লইও না। যাহা আমি হাতে করিয়া দিব, তাহাই তুমি লইবে, আপনা আপনি কোনও দ্রব্য স্পর্শ করিবে না।”

 এইরূপ সতর্ক করিয়া ব্যাঘ্র সে স্থান হইতে চলিয়া গেলেন।

 কিছুক্ষণ পরে খেতু আসিয়া কঙ্কাবতীর সম্মুখে দাঁড়াইলেন।

 খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কঙ্কাবতী আমাকে চিনিতে পার?”

 কঙ্কাবতী ঘাড় হেঁট করিয়া রহিলেন।

 খেতু পুনরায় বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! এই বনের মাঝখানে আসিয়া তোমার কি ভয় করিতেছে?”

 কঙ্কাবতী মৃদুস্বরে উত্তর করিলেন,— “না, আমার ভয় করে নাই। তোমাকে দেখিয়া আমার ঘোমটা দেওয়া উচিত, লজ্জা করা উচিত। তাহা পারিতেছি না। তাই আমি ভাবিতেছি। তুমি কি মনে করিবে।

 খেতু বলিলেন,— “না, কঙ্কাবতী আমারে দেখিয়া তোমার ঘোমটা দিতে হইবে না, লজ্জা করিতে হইবে না; আমি কিছু মনে করিব না, তাহার জন্য তোমার ভাবনা নাই। আর এখানে কেবল তুমি আর আমি, অন্য কেহ নাই, তাতে লজ্জা করিলে চলিবে কেন? তাও বটে, আবার এখানে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নই। বিপদের আশঙ্কা বিলক্ষণ আছে।

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি বিপদ?”

 খেতু বলিলেন,— “এখন সে কথা শুনিয়া তোমার কাজ নাই। তাহা হইলে তুমি ভয় পাইবে। এখন সে কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করিও না। তবে, এখন তোমাকে এইমাত্র বলিতে পারি যে, যদি তুমি এখানকার দ্রব্যসামগ্রী স্পর্শ না কর, তাহা হইলে কোনও ভয় নাই; কোনও বিপদ হইবার সম্ভাবনা নাই। যেইটি আমি হাতে তুলিয়া দিব, সেইটি লইবে; নিজ হাতে কোনও দ্রব্য লইবে না। একবৎসরকাল আমাদিগকে এইখানে থাকিতে হইবে। তাহার পর, এ সমুদয় ধনসম্পত্তি আমাদের হইবে। এই সমুদয় ধন লইয়া তখন আমরা দেশে যাইব। আচ্ছা! কঙ্কাবতী যখন আমি তোমাকে বিবাহ করি, তখন তুমি আমাকে চিনিতে পারিয়াছিলে?”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “তা আর পারি নি? একবৎসরকাল তোমার জন্য পথপানে চাহিয়াছিলাম। যখন একবৎসর গত হইয়া গেল, তখনও তুমি আসিলে না, তখন মা আর আমি, হতাশ হইয়া পড়িলাম। মা যে কত কাঁদিতেন, আমি যে কত কাঁদিতাম, তা আর তোমাকে কি বলিব! কাল রাত্রিতে বাবা যখন বলিলেন যে, বাঘের সহিত আমি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব, আর সেই কথায় তুমি যখন বাহির হইতে বলিলে,— “তবে কি মহাশয়! দ্বার।

৬৪
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ