পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সর্ব্বশরীর কাপিতে লাগিল।

 চমকিয়া খেতু জাগরিত হইলেন। মাথায় হাত দিয়া দেখিলেন যে, শিকড় নাই। ভয়ে বিহ্বলা, কম্পিত-কলেবরা, জ্ঞানহীনা, কঙ্কাবতীকে সম্মুখে দণ্ডায়মান দেখিলেন। অচেতন হইয়া, কঙ্কাবতী ভূতলশায়িনী হন। আর কি, এমন সময় খেতু উঠিয়া তাঁহাকে ধরিলেন। বাতিটি তাহার হাত হইতে লইয়া, কঙ্কাবতীকে আস্তে আস্তে বসাইলেন। কঙ্কাবতীর মুখে জল দিয়া, কঙ্কাবতীকে সুস্থ করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করিলেন।

 সুস্থ হইয়া কঙ্কাবতী বলিলেন,— “আমি যে, ঘোর কুকর্ম্ম করিয়াছি, তাহা আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি। আমাকে তুমি ক্ষমা কর!”

 এই কথা বলিয়া, কঙ্কাবতী অধোবদনে বসিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! ইহাতে তোমার কোনও দোষ নাই। প্রথম তো অদৃষ্টের দোষ। তা না হইলে এতদিন গিয়া আজ এ দুর্ঘটনা ঘটিবে কেন? তাহার পর আমার দোষ। আমি যদি আদ্যোপান্ত সকল কথা তোমাকে প্রকাশ করিয়া বলিতাম, যদি তোমার নিকট কিছু গোপন না করিতাম, তাহা হইলে একাজ তুমি কখনই করিতে না, আজ এ দুর্ঘটনা ঘটিত না। শিকড়টি কি বাতির আগুনে পোড়াইয়া ফেলিয়াছ?”

 কঙ্কাবতী ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন,— “হাঁ। শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিয়াছি।”

 খেতু বলিলেন,— “তবে এখন তোমাকে বুকে সাহস বাঁধিতে হইবে। স্ত্রীলোক, বালিকার মত এখন আর কাঁদিলে চলিবে না। এই জনশূন্য অরণ্যের মধ্যে তুমি একাকিনী! তোমার জন্য প্রাণ আমার নিতান্ত আকুল হইয়াছে। কঙ্কাবতী প্রকৃত যাহারা পুরুষ হয়, মরিতে তাহারা ভয় করে না। অনাথিনী স্ত্রী প্রভৃতি পোষ্যদিগের জন্যই তাহারা কাতর হয়।”

 ব্যস্ত হইয়া কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কেন? কি? আমাদের কি বিপদ হইবে? কি বিপদের আশঙ্কা তুমি করিতেছ?”

 খেতু উত্তর করিলেন,— “কঙ্কাবতী! যদি গোপন করিবার সময় থাকিত, তাহা হইলে আমি গোপন করিতাম। কিন্তু গোপন করিবার আর সময় নাই। তোমাকে একাকিনী এস্থান হইতে বাটী ফিরিয়া যাইতে হইবে। সুড়ঙ্গের ভিতর হইতে বাহির হইয়া ঠিক উত্তরমুখে যাইবে। প্রাতঃকাল হইলে সূর্য উদয় হইবে, সূর্য্যকে দক্ষিণদিকে রাখিয়া চলিলেই তুমি গ্রামে গিয়া পৌছিবে।”

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “আর তুমি?”

 খেতু বলিলেন, — “আমাকে এইখানেই থাকিতে হইবে। আমি এ-স্থানের দ্রব্য ছুইয়াছি, এখান হইতে আমি টাকাকড়ি লইয়াছি, সুতরাং এখান হইতে আমি আর যাইতে পারিব না। আমাকে এইখানেই থাকিতে হইবে। সেইজন্য এখানকার কোনও দ্রব্য স্পর্শ করিতে তোমাকে মানা করিয়াছিলাম। এক্ষণে তুমি আর বিলম্ব করিও না। অট্টালিকা হইতে বাহির হইয়া সুড়ঙ্গপথে গমন করিবে। পর্ব্বতের ভিতর হইতে বাহির হইয়া কোনও গাছতলায় রাত্রিটি যাপন করিবে। যখন প্রাতঃকাল হইবে, সূর্য উদয় হইবে, তখন কোন দিক উত্তর, অনায়াসেই জানিতে পরিবে। উত্তরমুখে যাইলেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইবে। কঙ্কাবতী! আর বিলম্ব করিও না।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “এ-স্থান হইতে আমি যাইব? তোমাকে এইখানে রাখিয়া আমি এখান হইতে যাইব? এমন কথা তুমি কি করিয়া বলিলে? আমি ঘোরতর কুকর্ম্ম করিয়াছি সত্য, আমি অপরাধিনী সত্য, আমি হতভাগিনী। কিন্তু তা বলিয়া কি আমাকে দূর করিতে

কঙ্কাবতী
৭১