পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৬৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মদান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভাতে ঘুম থেকে উঠে মন যেদিন শাস্ত থাকে, কোনো চিন্তার দ্বারা বিক্ষুব্ধ না থাকে, তেমন মনে যে-চেতনার উদ্বোধন হয় সেটির সঙ্গে বিশ্বের প্রকাশের একটি সম্পূর্ণ মিল থাকে। প্রভাতের সেই প্রথম মুহূর্তে যে-আনন্দ, পাখীর গানে পল্লবমৰ্ম্মরে তরুলতায় চিকণ কিরণসম্পাতের মধ্যে যে-অনুভূতি, তার মধ্যে দিয়ে নিজের সঙ্গে বিশ্বের যে-যোগ সেটিকে জানি । দিনের কাজের মধ্যে নানা চিন্তায় নিরুদ্ধ হয়ে আমরা হারিয়ে যাই। তখন আর সে বিশ্ববোধের ভাবটি উজ্জল থাকে না। প্রভাতে চিন্তার তরঙ্গ যখন শাস্ত হয়ে আছে তখন আমি সকলের মধ্যে আছি , আপনার থেকে বেরিয়ে পরম শান্তির সঙ্গে আমাদের যে যোগ, সেটিকে নূতন করে উপলব্ধি করি। প্রভাতে পার্থীর গানের মধ্যেও এই আনন্দ ; যাঁ-কিছু পরিচিত এই আকাশ বাতাস, তার মধ্যে পার্থী আছে, সে হারায়নি। সমস্ত বিশ্বের সঙ্গে এই সত্য সম্বন্ধটি জানবার দরকার ছিল। প্রভাতে কোলাহল নেই, বিশেষ প্রয়াস নেই, তাই বিশ্বের সঙ্গে আমার চিরন্তন যোগটি সহজেই অনুভব করি। প্রভাতের শুভ্র আলোকের লীলা যখন বাইরে তাকিয়ে দেখি তখন সহজেই আনন্দ হয়। নদীর যে-অংশ তিন দিকে আবদ্ধ এক দিকে খোলা তাকে বলে নদীর কোল। পদ্মার কোলে নৌকায় আমি দীর্ঘ দিন বাস করেছি, সেখানকার জল বয় না, ডাঙার দিকে আবদ্ধ। সেই অবরোধের এক দিক দিয়ে স্রোত বয়ে যাচ্ছে, .অবরোধে ম্রোতের গতি নেই। সেখানে নদীর যেন দুটি রূপ দেখতে পেলুম। এক দিক ডাঙায় আটকে গিয়ে তার যাত্রপথকে তুলেছে, অপর দিকের স্রোত নিরস্তর বাধাহীন গতিতে সমুদ্রের দিকে চলেছে। আমাদের জীবনের এমুনি ছুটি রূপ আছে। এক দিকে সে অবরুদ্ধ ; জীবনের অন্ত দিক যে অসীম সত্যের দিকে ছুটে চলেছে সে কথাটা আমরা তখন উপলদ্ধি করি না ; তার গতি ভাঙার দিকে, সে বোবা জল, কথা কয় না, সংসারে বন্ধ, আচল । সেখানে যে ফেনপুঞ্জ প্রবেশ করেছে সে ক্রমে জমে ওঠে-যত ফেলে-দেওয়া খসে-পড়া ভেসে-আসা জিনিষ আর বেরোবার পথ পায় না, পুস্ত্রীভূত হয়ে ওঠে, পলি পড়ে ক্রমশ তার গভীরতা হ্রাস হয়ে আসে, অবরোধ সম্পূর্ণ হয়। নদীর সঙ্গে তার যে চিরস্থন যোগ তা সে আর খুঁজে পায় না। সংসার তার কাছে যতই বড় হয়ে ওঠে ততই বিশ্বের সঙ্গে তার সত্য যোগ ছিন্ন হয়ে যায়। তথন মনে করি আমিই বেশি, আমার মুখদু:খের মূল্য সকল সত্যের চেয়ে বড়— ঐখানেই সত্য পীড়িত হয়, অহং যেখানে চিত্তস্রোতকে অবরুদ্ধ করে, বিশ্বের সঙ্গে তার যোগকে ভুলিয়ে দেয় সেখানেই সে মুহমান হয়, সেখানে কণ্ঠে তার বাণী নেই, আপনাকে সে বিশ্বত হয়েছে। আমাদের জীবনের এই যে অংশ যেখানে সে নিজের সাংসারিক খ্যাতি-প্রতিপত্তি মুখ-দুঃখকেই বড় করে দেখেছে একে অবজ্ঞা করব না। এটাতে আমাদের বিশেষ বিপদ নাও ঘটতে পারে, যদি যে-দিকুট খোলা আছে, ধারা যেদিকে রুদ্ধ হয়নি তার সঙ্গে আমাদের বিচ্ছেদ না ঘটে। নদীর কোলের যদি চৈতন্য থাকৃত তাহলে সে জানত যে, যেদিকে নদী আপনাকে দান করছে, গভীরতা যেখানে ব্যাহত হয়নি, স্বচ্ছতা যেখানে অনাবিল সেদিকেই সে সত্য। যদি সে চিন্তা করতে পাৰ্বত তাহলে সে বুঝত যে, যেদিকে সে সব ভাসিয়ে দিতে পারে সেদিকেই তার প্রকৃত পরিচয় । সে-দিকটা আমরা হয়ত প্রায়শই জীবনে অনুভব করি, যেদিকে আমরা শুধু সঞ্চয় করতে চাইনে, ইচ্ছে করে ক্ষতিকেও চাই, দুঃখকেও চাই—সেইটেই স্রোতের দিক। এমন প্রেম যদি আমাদের দেশের প্রতি বন্ধুর প্রতি বা কোনো সৌন্দৰ্য্যন্থটির প্রতি হয়, তাহলে আমরা আপনাকে ভুলতে পারি—বুঝতে পারি, এ ত শুধু আমার নিজের দিকের কথা নয়। পরম প্রেমের এই আনন্দ যখন আমাদের আপনাকে ভুক্তিয়ে দেয় তখন মৃত্যুভয়ও চলে যায়, মৃত্যুকেও তখন অসত্য