পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৫২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রজনী কায়েতের কুলে তুমিই ধন্য! তোমার মত কেহ নাই। কিন্তু আমি তোমার দান গ্রহণ করিব না।” রজনী বলিল, “না গ্ৰহণ করেন, আমি ইহা বিলাইয়া দিব।” আমি। অমরনাথ বাবকে ? রজনী। আপনি উহাকে সবিশেষ চিনেন না ; আমি দিলেও উনি লাইবেন না। লইবার অন্য লোক আছে । আমি। অমরনাথ বাবা কি বল ? অমর। আমার সঙ্গে কোন কথা হইতেছে না, আমি কি বলিব ? আমি বড় ফাঁপরে পড়িলাম ; রজনী যে বিষয় ছাড়িয়া দিতেছে, তাহাতে বিসিমত ; আবার অমরনাথ যে বিষয় উদ্ধারের জন্য এত করিয়াছিল, যাহার লোভে রজনীকে বিবাহ করিবার জন্য উদ্যোগ করিতেছে, সে বিষয় হাতছাড়া হইতেছে, দেখিয়াও সে প্রফতুল্ল। কান্ডাখানা কি ? আমি অমরনাথকে বলিলাম যে, যদি সন্থানান্তরে যাও, তবে আমি রজনীর সঙ্গে সকল কথা মািখ ফটিয়া কই । অমরনাথ আমনি সরিয়া গেল। আমি তখন রজনীকে বলিলাম, “সত্য সত্যই কি তুমি বিষয় বিলাইয়া দিবে ?” “সত্য সত্যই। আমি গঙগাজল নিয়া শপথ করিয়া বলিতেছি।” আমি। আমি তোমার দান লই, তুমি যদি আমার কিছ, দান লও। রজনী । অনেক লইয়াছি। আমি। আরও কিছ: লাইতে হইবে। রজনী। একখানি প্ৰসাদি কাপড় দিবেন। আমি । তা না। আমি যা দিই, তাই নিতে হইবে। রজনী। কি দিবেন ? আমি। শচীন্দ্ৰ বলিয়া আমার একটি পত্র আছে। আমি তোমাকে শচীন্দ্র দান করিব। স্বামীরাপে তুমি তাহাকে গ্রহণ করিবে। তুমি যদি তাহাকে গ্রহণ কর, তবেই আমি তোমার বিষয় গ্রহণ করিব। রজনী দাঁড়াইয়াছিল, ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িয়া অন্ধ নয়ন মন্দিল। তার পর তাহার মাদিত নয়ন হইতে অবিরল জলধারা পড়িতে লাগিল—-চক্ষের জল আর ফরায় না। আমি বিষম বিপদে পড়িলাম। রজনী কথা কহে না—কেবল কাঁদে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি রজনি! অত কাঁদা কেন ?” রজনী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “যে দিন গঙ্গার জলে আমি ডুবিয়া মরিতে গিয়াছিলাম— ডুবিয়াছিলাম, লোকে ধরিয়া তুলিল। সে শচীন্দ্রের জন্য। তুমি যদি বলিতে, তুমি অন্ধ, তোমার চক্ষ ফটাইয়া দিব-আমি তােহা চাহিতাম না—আমি শচীন্দ্র চাহিতাম। শচীন্দ্রের অপেক্ষা এ জগতে আর কিছই নাই-আমার প্রাণ তাঁহার কাছে, দেবতার কাছে ফলের কলিমাত্ৰ—শ্ৰীচরণে সথান পাইলেই সার্থক। অন্ধের দঃখের কথা শনিবে কি ?” আমি রজনীর কাতরতা দেখিয়া কাতর হইয়া বলিলাম, “শনিব।” তখন রজনী কাঁদিতে কাঁদিতে, হৃদয় খলিয়া আমার কাছে সকল কথা বলিল। শচীন্দ্রের কন্ঠ, শচীন্দ্রের সপশ, অন্ধের রপোন্মাদ ! তাহার পলায়ন, নিমজন, উদ্ধার, সকল বলিল । বলিয়া বলিল, “ঠাকুরাণি, তোমাদের চক্ষ আছে—চক্ষ থাকিলে এত ভালবাসা বাসিতে পারে কি ?” মনে মনে বলিলাম, “কাণি! তুই ভালবাসার কি জানিস! তুমি লবঙ্গলতার অপেক্ষা সহস্ৰগণে সখী।” প্রকাশ্যে বলিলাম, “না, রজনি, আমার বাড়া স্বামী—আমি অত শত জানি না। তুমি শচীন্দ্রকে তবে বিবাহ করিবে, ইহা সিথর ?” রজনী বলিল, “না।” আমি। সে কি ? তবে এত কথা কি বলিতেছিলে—এত কাঁদিলে কেন ? রজনী। আমার সে সখি কপালে নাই বলিয়াই এত কাঁদিলাম। আমি। সে কি ? আমি বিবাহ দিব। রজনী। দিতে পারিবেন না। অমরনাথ হইতে আমার সব্বস্ব। অমরনাথ আমার বিষয় উদ্ধারের জন্য যাহা করিয়াছেন, পরের জন্য পরে কি তত করে ? তাও ধরি না, তিনি আপনার প্ৰাণ দিয়া আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছেন। ○之9