পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৬
বাংলা শব্দতত্ত্ব

কথাগুলা ও তাহার প্রত্যয় সংগ্রহে সহায়তা করিয়া বাংলা ভাষাটাকেই মাটি করিবার চেষ্টায় আছি।

 যে-কথা লইয়া আমি আলােচনা করিয়াছিলাম, তাহাদিগকে বাংলায় রাখা বা বাংলা হইতে খারিজ করিয়া দেওয়া আমার বা আর-কাহারাে সাধ্যই নহে। তাহারা আছে, এবং কাহারাে কথায় তাহারা নিজের স্থান ছাড়িবে না। জগতে যে-কোন জিনিসই আছে, তাহা ছােটো হউক আর বড় হউক, কুৎসিত হউক আর সুশ্রী হউক, প্রাদেশিক হউক আর নাগরিক হউক, তাহার তত্ত্বনির্ণয় বিজ্ঞানের কাজ। শরীরতত্ত্ব কেবল উত্তমাঙ্গেরই বিচার করে এমন নহে, পদাঙ্গুলিকেও অবজ্ঞা করে না। বিজ্ঞানের ঘৃণা নাই, পক্ষপাত নাই।

 কিন্তু এই বাংলা চলিত কথাগুলি এবং সংস্কৃত-ব্যাকরণনিরপেক্ষ বিশেষ নিয়মগুলির উল্লেখমাত্র করিলেই বাংলা ভাষা নষ্ট হইয়া যাইবে, এমন ধারণা কেন হয়। হিন্দুঘরে গ্রাম্য আত্মীয়ের, দরিদ্র আত্মীয়েরও তো প্রবেশনিষেধ নাই। যদি কেহ নিষেধ করিতে উদ্যত হয়, তবে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে হয়তাে জবাব দেয়, উহারা আত্মীয় বটে কিন্তু কুলত্যাগ করিয়া জাতিভ্রষ্ট হইয়াছে।

 বাংলায় যাহা-কিছু সংস্কৃতের নিয়ম মানে না, তাহাকে এক দল লােক কুলত্যাগ বলিয়া ত্যাগ করিতে চান। এবং সংস্কৃতের নিয়মকে বাংলায় সর্বত্রই প্রতিষ্ঠিত করিতে তাঁহাদের চেষ্টা। তাঁহাদের বিশ্বাস, স্বরচিত ব্যাকরণে তাঁহারা সংস্কৃত-নিয়মকে জাহির করিলে এবং বাংলা-নিয়মের উল্লেখ না করিলেই, বাংলা ভাষা সংস্কৃত হইয়া দাঁড়াইবে। তাহারা মনে করেন, ‘পাগলাম’ এবং ‘সাহেবিয়ানা’ কথা যে বাংলায় আছে, ও ‘আম’ এবং আমা’ -নামক সংস্কৃতেতর প্রত্যয়-দ্বারা তাহারা সিদ্ধ, এ কথা না তুলিলেই আপদ চুকিয়া যায়– এবং যখন প্রয়ােজন হয়, তখন ‘উন্মত্ততা’ ও ‘ইংরাজানুকৃতিশীলত্ব’ কথা ব্যবহার করিলেই গ্রাম্য কথা দুটার অস্তিত্বই ঢাকিয়া রাখা যাইবে।

 বাংলা ব্যাকরণ যে প্রায় সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইহাই প্রতিপন্ন করিবার জন্য তাঁহারা বাংলার কারক-বিভক্তিকে সংস্কৃত কারক-বিভক্তির সঙ্গে অন্তত সংখ্যাতেও সমান বলিতে চান।

 সংস্কৃত ভাষায় সম্প্রদানকারক বলিয়া একটা স্বতন্ত্রকারক আছে, বিভক্তিতেই