পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রাচীন-কাব্য সংগ্রহ
৩৩১

গেলে ‘ভাঙবি’ শব্দের অর্থ ‘প্রকাশ করিতেছে’ কোনমতেই হয় না। ‘বি’ অন্ত ধাতু কোনমতেই বর্তমান কাল-বাচক হইতে পারে না। বিদ্যাপতির সমস্ত পদাবলীর মধ্যে কোথাও এমনতর দেখা যায় না। ‘ভাঙবি’ অর্থে ‘তুই প্রকাশ করিবি’ হয়, অথবা স্ত্রীলিঙ্গ কর্তা থাকিলে ‘সে প্রকাশ করিবে’ও হয়, কিন্তু বর্তমান কাল-বাচক ক্রিয়ায় ‘বি’ যােগ বিদ্যাপতির কোনাে পদেই দৃষ্ট হয় না। এমন স্থলে ‘ভাঙ বিভঙ্গি বিলাস’ পাঠ কী কারণে অসংগত বুঝিতে পারা যায় না। রাধিকার নয়ন-নলিনীদ্বয় অঞ্জনে রঞ্জিত, এবং তাহার ভ্রূ বিভঙ্গি-বিলাস। অর্থাৎ বিভঙ্গিতেই তাহার ভ্রূর বিলাস। এ অর্থ আমাদের নিকট বেশ সুসংগত বােধ হইতেছে।

অলখিতে মােহে হেরি বিহসিতে থােরি।
জনু বয়ান বিরাজে চান্দ উজোরি।
কুটিল কটাক্ষ ছটা পড়ি গেল।
মধুকর ডম্বর অম্বর ভেল।  সং ৯, পৃ. ১০

 সম্পাদক শেষ দুই চরণের অর্থ এইরূপ করিয়াছেন: ‘কুটিল কটাক্ষের শােভায় চারি দিক এমন শোভিত হইল যেন মধুকর ডামরে (মৌমাছির ঝাঁকে) আকাশ (অম্বর) আচ্ছন্ন হইল। ‘যেন’ শব্দ কোথা হইতে পাইলেন, এবং ‘আচ্ছন্ন’ শব্দই বা কোথা হইতে জুটিল? আমরা ইহার এইরূপ অর্থ করি— ‘অলখিত ভাবে আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাস্য করাতে তাহার মুখ উজ্জ্বল চাঁদের ন্যায় বিরাজ করিতে লাগিল। মুখ যদি চাঁদ হইল, কটাক্ষ সে চাঁদের ছটা স্বরূপ হইয়া পতিত হইতে লাগিল এবং মধুকরের ঝাঁক সে চাঁদের অম্বর অর্থাৎ আকাশ হইল। রাধার মুখের গন্ধে এত মধুকর আকৃষ্ট হইয়াছিল।’ এই গীতেরই মধ্যে মধুপের কথা পুনশ্চ উল্লেখ করা হইয়াছে; যথা—

লীলাকমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি।
চমকি চললু ধনি চকিত নেহারি। পৃ.১১

 অর্থাৎ ‘লীলাকমলের দ্বারা ভ্রমরকে কিবা নিবারণ করিয়া, চকিতে চাহিয়া চমকিয়া ধনী চলিল।’ ইহাতে কুমারসম্ভবের তৃতীয় সর্গে গৌরীর বর্ণনা মনে পড়ে—

অমর ভূষিত হয়ে নিশ্বাস সৌরভে
বিম্ব অধরের কাছে বেড়ায় ঘুরিয়া,