পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মুক্ত বাচনের প্রতীতি

মিখায়েল বাখতিন। কোনো নিরিখেই নিছক নাম নয় শুধু, নিয়ত বিকাশমান চিন্তাপ্রস্থানের কেন্দ্র। কয়েক বছর আগেও অগ্রণী বাঙালি পড়ুয়ারা বাখতিনকে তত্ত্ববিদদের জমায়েতে নিছক আরো একজন কেউ বলে ভাবতেন। দেবেশ রায়ের পথ-প্রদর্শক বিশ্লেষণের পরে বাংলায় বাখতিন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বই বেরিয়েছে। এবং এই সময় বাখতিন সংখ্যা প্রকাশ করেছে। এছাড়া আরো কয়েকটি ছোট পত্রিকা বাখতিন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা-ঋদ্ধ প্রবন্ধ ছেপেছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই জায়মান চিন্তাপ্রস্থান অনুশীলন করে উপন্যাস-আলোচকেরা নতুন নতুন ভাববীজ নিয়ে আসছেন তাদের প্রতিবেদনে। তবু এত কিছু সত্ত্বেও এখনো তো গেল না আঁধার, এখনো দ্বিধা ও সংশয় কারো কারো পদচারণাকে কুণ্ঠিত করে রাখে। বিশেষত বাঙালি বৌদ্ধিক সমাজের একটি বিচিত্র ব্যাধি একুশ শতকেও অটুট রয়ে গেছে। সব কিছুকেই টুকরো করে দেখতে ও দেখাতে অভ্যস্ত বলে কোথাও সামগ্রিকতার প্রতীতি এদের অনেকের মনেই কিছুমাত্র রেখাপাত করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সর্বগ্রাসী অনিকেত বোধ ও অনবস্থার প্রবণতায় স্বেচ্ছাসমর্পিত হওয়ার ফলে নান্দনিক ও সামাজিক ভাবাদর্শন্য পরিসরে এদের বিচরণ। সব কিছুকে সন্দেহ করার মধ্যে কোনো দার্শনিক প্রণালী ব্যক্ত হয়। না; এদের বয়ানে আত্মিক নৈরাজ্য, চূড়ান্ত অগভীরতা ও একরৈখিক ভাবনার কৃষ্ণ-বিবর শুধু উন্মোচিত হয়। তৃতীয়ত এরা বাখতিনকে অন্য সাধারণ চিন্তা-প্রস্থানের প্রবক্তাদের মতো মনে করেন। এরা ভূলে যান, বাখতিনীয় চিন্তা-প্রকল্প মূলত বহুবাচনিক ও অনেকান্তিক। জীবনের পাঠকৃতি কী বিস্ময়কর ভাবে মুক্ত—এই উপলব্ধির তাৎপর্য কত বিচিত্রভাবে অনুসরণ করা সম্ভব, বাখতিনীয় ভাববীজ সেই সত্য বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। কিন্তু এরা সেকথা মানতে নারাজ।

 আসলে সব ধরনের অগভীর সফরীসঞ্চরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা যথার্থ বাখতিন-অনুশীলন থেকে পাওয়া সম্ভব। জিজ্ঞাসু সত্তা জীবন ও জগতের সঙ্গে কীভাবে তার সম্পর্ক গড়ে তুলবে, সময় ও পরিসরের প্রতীয়মান অবয়বের নির্মোক ভেদ করে কীভাবেই বা গড়ে তুলবে অস্তিত্বের একক ও সামূহিক বোধ—এই অত্যন্ত মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন পাঠও বাখতিন-ভাবনা থেকে পাওয়া সম্ভব। যতক্ষণ এই জরুরি প্রাথমিক কথাটি না বুঝতে পারছি, অন্তত ততক্ষণ ছ’জন অন্ধের হাতি দেখার রূপকটি ফিরে ফিরে আসবে। আধুনিকোত্তর চিন্তাপ্রণালী যখন ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালি সমাজে নানা ধরনের জটিল স্ববিরোধিতাও কূটাভাস, অনন্যয় ও মরীচিকা-প্রীতির সূচনা করেছে, বাখতিন-ভাবনাকে উত্তরোত্তর বিকশিত করার স্বার্থে নতুন পুনঃপাঠের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা কেউই ইতিহাসের বাইরে নই; বাখতিনের চিন্তা-প্রবাহও ইতিহাসের নির্মিতি। আবার বাখতিন তাঁর বহুস্বরিক চেতনা দিয়ে ভাবনার ইতিহাসকেও আমূল পুনর্বিন্যস্ত করে নিয়েছেন। তেমনি আমরাও আধিপত্যবাদ-স্পষ্ট নির্মিতিকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের ভাবনার জায়মান ইতিহাসকে পুনর্গঠন করতে পারি। এই প্রক্রিয়া যতক্ষণ সচল থাকে, ততক্ষণই আমাদের অস্তিত্ব স্পন্দমান। একটাই শর্ত শুধু; সাহিত্যতাত্ত্বিক-সমাজতান্ত্রিক-দার্শনিক-

৪৩