পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৮৪
বিচিত্র প্রবন্ধ

 জীবন বৃথা গেল! যাইতে দাও! কারণ, যাওয়া চাই। যাওয়াটাই একটা সার্থকতা। নদী চলিতেছে—তাহার সকল জলই আমাদের স্নানে এবং পানে এবং আমন ধানের ক্ষেতে ব্যবহার হইয়া যায় না। তাহার অধিকাংশ জলই কেবল প্রবাহ রাখিতেছে! আর কোনো কাজ না। করিয়া কেবল প্রবাহরক্ষা করিবার একটা বৃহৎ-সার্থকতা আছে। তাহার যে জল আমরা খাল কাটিয়া পুকুরে আনি, তাহাতে স্নান করা চলে, কিন্তু তাহা পান করি না; তাহার যে জল ঘটে করিয়া আনিয়া আমরা জালায়। ভরিয়া রাখি, তাহা পান করা চলে, কিন্তু তাহার উপরে আলো-ছায়ার উৎসব হয় না। উপকারকেই একমাত্র সাফল্য বলিয়া জ্ঞান করা কৃপণতার কথা, উদ্দেশ্যকেই একমাত্র পরিণাম বলিয়া গণ্য করা দীনতার পরিচয়।

 আমরা সাধারণ পনেরো-আনা, আমরা নিজেদের যেন হেয় বলিয়া না জ্ঞান করি। আমরাই সংসারের গতি। পৃথিবীতে, মানুষের হৃদয়ে আমাদের জীবনস্বত্ব। আমরা কিছুতেই দখল রাখি না, আঁক্‌ড়িয়া থাকি না, আমরা চলিয়া যাই। সংসারের সমস্ত কলগান আমাদের দ্বারা ধ্বনিত, সমস্ত ছায়ালোক আমাদের উপরেই স্পন্দমান। আমরা যে হাসি, কাঁদি, ভালোবাসি; বন্ধুর সঙ্গে অকারণ খেলা করি; স্বজনের সঙ্গে অনাবশ্যক আলাপ করি; দিনের অধিকাংশ সময়ই চারিপাশের লোকের সহিত উদ্দেশ্যহীনভাবে যাপন করি, তার পরে ধুম করিয়া ছেলের বিবাহ দিয়া তাহাকে আপিসে প্রবেশ করাইয়া পৃথিবীতে কোনো খ্যাতি না রাখিয়া মরিয়া-পুড়িয়া ছাই হইয়া যাই—আমরা বিপুল সংসারের বিচিত্র তরঙ্গলীলার অঙ্গ; আমাদের ছোটোখাটো হাসিকৌতুকেই সমস্ত জনপ্রবাহ ঝল্‌মল্‌ করিতেছে, আমাদের ছোটোখাটো আলাপে-বিলাপে সমস্ত সমাজ মুখরিত।

 আমরা যাহাকে ব্যর্থ বলি, প্রকৃতির অধিকাংশই তাই। সূর্য্য-