পাতা:বিচিন্তা - রাজশেখর বসু.pdf/১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিচিন্তা

ব্যাপী একটি ঘটনাপ্রবাহ। এ ভিন্ন যদি আমার অন্যবিধ সত্তা মানা হয় তবে তা ক্ষণিক, অসম্পূর্ণ, অথবা অপ্রমাণিত।

 আপাত দৃষ্টিতে হিমালয় যতই অটল অচল মনে হ’ক, তারও পরিবর্তন ঘটছে, অতএব হিমালয় একটি ঘটনাপ্রবাহ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও এইরকম, তাই ‘জগৎ’ আর ‘সংসার’ নাম। গঙ্গার যে জলরাশি এই মুহূর্তে দেখছি পর মুহূর্তে তা চলে গেছে, তার স্থানে অন্য জলরাশি এসেছে, তটরেখাও ক্রমশ বদলাচ্ছে, গঙ্গার কোনও অংশই স্থায়ী নয়। এই কারণেই গ্রীক পণ্ডিত হেরাক্লাইটস বলেছিলেন, একই নদী দুবার পার হওয়া যায় না। নির্বাত স্থানে প্রদীপের শিখা একটি স্থির পদার্থ বলে মনে হয়। তেলের বাষ্প আর বাতাসের অক্সিজেন একসঙ্গে মিশে জ্বলছে এবং এই দুই উপাদান নিরন্তর বদলাচ্ছে; এই ঘটনাপ্রবাহকেই আমরা দীপশিখা রূপে দেখি।

 প্রদীপ নিবে গেলে তার শিখা কোথায় যায়? মৃত্যুর পরেও কি আত্মার অস্তিত্ব থাকে? আমরা কিছুই জানি না। নদী আর প্রদীপ অচেতন তাই তাদের আত্মার কথা আমাদের মনে আসে না। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চেতন অবস্থায় যে অহংজ্ঞান থাকে, আমি পূর্বে এই করেছিলাম, এখন এই করছি, এই ছিলাম, এখন এই হয়েছি―এই ধারাবাহিক জ্ঞান বা স্মৃতিই আমার ব্যক্তিত্ব, তাকেই আত্মা মনে করতে পারি। মহাভারতের উপমা অনুসারে বলা যেতে পারে―মহাকালসমুদ্রে ঘটনাপ্রবাহরূপ অসংখ্য কাষ্ঠ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, আমি তাদেরই একটি। অন্যান্য যে সকল সচেতন কাষ্ঠ আমার সংসর্গে আসে―অর্থাৎ তাদের সঙ্গে যখন আমার এককালসম্বন্ধ হয় তখন তাদের আমি জীবিত মনে করি। যে কাষ্ঠ সরে যায় তাকে মৃত মনে করি। আমি স্বয়ং যখন আমার সঙ্গীদের কাছ থেকে দূরে চলে যাই তখন তারা আমাকে মৃত মনে করে। তার পরেও