পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৮
ভগবতী দেবী

বিশ্বাসকে বলিদান দিয়া, আমি কখনই কপটতাচরণ করিতে পারিব না। যদি কেহ আমার এক হস্তে সূর্য্য ও অপর হতে চন্দ্র প্রদান করিতে পারে, তথাপি আমার বিশ্বাস বিনষ্ট করিতে পারিব না। অন্তরের বিশ্বাসমত কার্য্য করিব, ইহাতে জীবন যায়, তজ্জন্য কিছুমাত্র দুঃখিত হইব না।”

 এক সময়ে খৃষ্টধর্ম্মসংস্কারক লুথারকে তাঁহার বন্ধুরা বলিয়াছিলেন, ‘লুথার! সাবধান হও, দেশমধ্যে অধিকাংশ লোকেই তোমার শত্রু; অতএব, যদি বাঁচিতে সাধ থাকে, তবে ধর্মসংস্কার ত্যাগ করিয়া, স্বীয় জীবন রক্ষা কর।” এই কথা শ্রবণ করিয়া লুথার গভীরভাবে উত্তর করিলেন, “যাহা আমার হৃদয়ের দৃঢ় বিশ্বাস, আমি সরল মনে তাহাই প্রচার করিতেছি। আমি আমার কর্ত্তব্যপথে বিচরণ করিতেছি, ইহাতে যদি এই মহানগরের যাবতীয় ইষ্টকরাশি আমার মস্তকে বর্ষিত হয়, তাহাতেও আমি কর্ত্তব্যকর্ম্ম হইতে বিমুখ হইব না। আমার অদৃষ্টে যাহাই ঘটুক না কেন, আমি সরলতা-ক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়া কণ্টকাকীর্ণ কপটতাপথে পদার্পণ করিব না।”

 ফলতঃ সরলতা ও পবিত্রতা সাধু হৃদয়ের অলঙ্কার। যাঁহার চরিত্র পবিত্র ও নিষ্কলঙ্ক, তাঁহার অতর বিমল চন্দ্রকিরণের ন্যায় সস্নিগ্ধ ও আনন্দপূর্ণ। সুর্য্য যেমন পথিবীর অন্ধকার দূরীভূত করিয়া চতুর্দ্দিক দিব্যালোকে আলোকিত করে, সরল ও পবিত্রহৃদয় সাধ, মহাপুরুষগণও সেইরপ পথিবীর পাপাচার বিনাশ করিয়া ধর্মের বিমল ও পবিত্র জ্যোতিতে বসুন্ধরাকে উদ্ভাসিত করেন। সরল হৃদয় মহাজন জগতের বিশ্বাস, ভক্তি ও সম্মানের পাত্র।

 ভগবতী দেবী সরলতা ও পবিত্রতাগণে ঐ প্রদেশের সকলেরই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান লাভ করিয়াছিলেন। তিনি মনের বিশ্বাস মত কার্য করিতেন। অন্তঃকরণের ভাব গোপন করিয়া কোনরুপ অন্যায় আচরণ করা তাঁহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। ফলতঃ তিনি প্রান্তেও অন্তরে এক প্রকার এবং কার্যে অন্যপ্রকার ব্যবহার করিয়া লোকের নিকট ঘৃণিত হইতেন না। অথবা অন্যের মনতুষ্টির জন্য ভীত হইয়া, বিশ্বাসের বিপরীত কার্য্য করিয়া কপটতাচরণ করিতেন না। যাহা সত্য বলিয়া হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতেন, প্রাণাতেও কার্যকালে তাহার অন্যথাচরণ করিতেন না। তিনি প্রায়ই বলিতেন, ‘সংসারের পথ অতি সরল, লোকে বুদ্ধির দোষে ইহাকে কুটিল করিয়া ফেলে। তুমি যাহা ফলভোগ কর, তাহার জন্য তুমিই দায়ী। তুমি দিবারাত্রি নিজে তোমার যত অনিষ্ট সাধন কর, আর কাহারও নিকট কখনও তত অনিষ্টের আশঙ্কা করিও না।” আমরা এস্থলে ভগবতী দেবীর সরলতা, পবিত্রতা ও সাধুতা গুণের একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত লিপিবদ্ধ করিয়া এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি করিব।

 বীরসিংহ গ্রামে বামুণী পুষ্করিণী নামে এক জলাশয় আছে। একদিন ভগবতী দেবী তথায় স্নান করিতেছেন, এমন সকয়ে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ স্নানার্থ