পাতা:বিদ্যাসাগর জীবনচরিত - শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন.pdf/১৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৬
বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত।

সুতরাং যাহারা নিত্য মজুরি করিয়া দিনপাত করিত, তাহাদের দিনপাত হওয়া কঠিন হইল। জাহানাবাদ-মহকুমার অন্তঃপাতী ক্ষীরপাই, রাধানগর, চন্দ্রকোণা প্রভৃতি গ্রামে অধিকাংশ তাঁতির বাস। তাঁতিরা বস্ত্র-বয়ন ব্যতীত অন্য কোন কার্য্য করিতে অক্ষম। সুতরাং যে অবধি বিলাতি কলের কাপড় হইয়াছে, তদবধি তন্তুবায়গণের অবস্থা ক্রমশঃ হ্রাস হইয়া আসিতেছিল। যেরূপ কাপড় ইহারা ২॥০ টাকা যোড়া বিক্রয় করিত, সেইরূপ কলের কাপড় ১॥০ বা ১৸০ যোড়া বিক্রয় হইতেছিল; সুতরাং তৎকালে ইহাদের বস্ত্র বিক্রয় হইত না। ঐ সময়ে টাকায় পাঁচ সেরা চাউল বিক্রয় হইত, তাহাও সকল সময়ে দুষ্প্রাপ্য। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র এই তিন মাস অনেকেই ঘটী, বাটী ও অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া, কথঞ্চিৎ প্রাণধারণ করে; পরে চাউল-ক্রয়ে অপারক হইয়া, কেহ কেহ বুনো-ওল ও কচু খাইয়া দিনপাত করে এবং নানাপ্রকার কষ্টভোগ করিয়া, অনাহারে অকালে কালগ্রাসে নিপতিত হয়। শত শত ব্যক্তি সমস্ত দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া, পেটের জ্বালায় কলিকাতায় প্রস্থান করে, ও তথায় পথে পথে ভিক্ষা করিয়া উদরপূর্ত্তি করিত। ৭৩ সালের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে এ প্রদেশের অর্থাৎ জাহানাবাদ মহকুমার প্রায় অশীতিসহস্ৰ লোক অন্নাভাবপ্রযুক্ত কলিকাতায় যাইয়া, তথাকার অন্নসত্রে ভোজন করিত। তৎকালে কেহ জাতির বিচার করে নাই। জননী, সন্তানকে পথে ফেলিয়া দিয়া, কলিকাতা প্রস্থান করেন। অনেক কুলকামিনী, জাত্যভিমানে জলাঞ্জলি দিয়া জাত্যন্তরিত হয়। চতুর্দ্দিকেই হাহাকার শব্দ, কেহ কাহারও প্রতি দয়া করে নাই, সকলেই অন্নচিন্তায় ব্যাকুল হইয়াছিল।

 আমাদের বীরসিংহবাসী অধিকাংশ লোক প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি ১০টা পর্য্যন্ত আমাদের দ্বারে দণ্ডায়মান থাকিত। তাহাদিগকে ভোজন না করাইয়া, আমরা ভোজন করিতে পারিতাম না। কোনও কোনও দিন রাত্রিতেও সন্নিহিত গ্রামের ভদ্রলোকগণ উদরের জ্বালায়, দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হইয়া চীৎকার করিত, তাহাদিগকে খাইতে না দিলে, সমস্ত রাত্রি চীৎকার করিত।