পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উৎকর্ণ WS)3X পরে গেলুম সজনীর বাড়ি। ছেলেবেলায় রাজকৃষ্ণ রায়ের পদ্য-মহাভারত একবার পড়েছিলুম, গ্রামে তখন কি একটা নিমন্ত্রণ ছিল । মা এক বাটি মুজি করে দিলেন খেতে অনেক দেরি হবে বলে, আর চালভাজা। আমি খেতে খেতে মহাভারতখানা পড়তে লাগলুম রান্নাঘরের মধ্যে বসে। কিন্তু সেদিন আর দেরি হয়নি, অল্প পরেই খাবার ডাক এসেছিল। আজ সেই মহাভারতথান সকালে পড়তে পড়তে ছেলেবেলার সেই কথাই মনে পড়েছিল । সজনীর বাড়ি অমিয় মোটর নিয়ে এল আমাদের নিয়ে যেতে। মনোজ বক্ষ আমাদের সঙ্গে যাবে বলে এসেচে। ওকে দেখে খুব খুশি হলুম। প্রেমেনকে তুলে নিলাম বরানগর থেকে বালী ব্রিজ পার হয়ে । আজকাল দক্ষিণেশ্বর একটা রেলওয়ে স্টেশন হয়েচে জানতুম না। শ্রীরামপুরে টাউন হলে যখন আমরা পৌছুলাম তখন চারটে বেজেচে । লোক আসতে শুরু হয়েচে । সভার কাজ আরম্ভ হল। প্রথমেই কথাসাহিত্য শাখার কাজ আরম্ভ করবার জন্তে সবাই মত দিলে । কাজেই আমার অভিভাষণ প্রথমেই পাঠ করতে হল। তারপরে প্রেমেনের। বেশ বিকেলটা । সভার কাজ করতে করতে ডাইনের বড় জানলা দিয়ে অপরাহের আকাশ ও একটা তালগাছের দিকে চেয়ে চেয়ে মনে হচ্ছিল আগে শ্রীরামপুরে আসতুম জ্ঞানবাবুর সঙ্গে—সে এক ধরণের দিন ছিল । আমাদের গ্রামে আমার খড়ের ঘরখানার কথাও মনে হল । বকুলতলায়ও এমনি ছায়া পড়ে এসেচে, এই তো সেদিন ছেড়ে এসেচি, কিন্তু তাদের কথা মনে হচ্ছে । সভার কাজ শেষ হবার কিছু আগে আমি চলে এলুম বিনয়দাদের বাড়ি। হরিহাস গাঙ্গুলী সামনের রবিবার শেওড়াফুলি যাবার নিমন্ত্রণ করলেন। দিদিদের বাড়ি দেখলুম শান্তি এসেচে, মামুও আছে। শাস্তি আমার অনেক বই পড়েচে, বলতে লাগল। ওখান থেকে উঠে লীলা দিদিদের বাড়ি এলাম। লীলা দিদি না খাইয়ে ছাড়লেন না। তারপর ট্রেনে আমি প্রেমেন, সুরেন গোস্বামী একসঙ্গে এলুম। মনোজদের দল আগের ট্রেনে চলে গিয়েচে সভা ভাঙতেই। বেশ কাটল রবিবারটা । কাল স্কুল খুলবে। পূজোর ছুটি আজই শেষ হল। ঘুমিয়ে উঠেই মনে পড়ল বহুদিনের কথা—যখন আমরা কেওট থেকে ফিরচি—আমার বয়স ছ'বছর—রজি ও পটদিদি আমাদের বাড়ির সামনের পথে বাশের খোল ও ধুলো নিয়ে খেলা করচে। ওরাও তখন নিতান্ত বালিকা। আজ এতক্ষণ পাগলা জেলে গিয়ে নদী থেকে নেয়ে এসেচে। কারণ সাড়ে এগারোটার ট্রেনে সে গিয়েচে–ওর কথা ভাবতেই মনে পড়ল । বারাকপুরকে মধুর করে গিয়েচে কত লোক। পিসীমা ছেলেবেলায়। মা, চক্কত্তি-খুড়ীমা, জ্যাঠাইমা, সইম, মণি আর একটু বেশী বয়সে। প্রথম যৌবনে গৌরী। এদের দান কত বড় তাই ভাবছিলুম। সেই পিসীমার উঠোন বাট দেওয়া, হেমন্তের এক বিকেলে হঠাৎ কোথায় অন্তৰ্দ্ধান। সেই গৌরী তাকের কোণে কি একটা নিতে এল । সদ্যস্নাত কিশোরী, ভিজে চুল পিঠে দুলচে। আমি কাছেই তক্তপোশে বসে পড়চি পুরানো বই—আমার দিকে চেয়ে লাজুকচোখে হাসলে । তারপর সেও কোথায় গেল চলে। মার কত দিনের কত ভালবাসা মনের মধ্যে গাথা রয়েচে । এখন যারা বারাকপুরে বাস করে তারা জানে না বারাকপুর কি। এখানে যে দেবী বাস করেন, সৌন্দৰ্য্যময়ী রহস্যময়ী গ্রাম্যদেবী—বরোজপোতার বঁাশবন রাঙা-রোদ সন্ধ্যাবেলায় তার আসন পাত, আমি যেন কতবার একল সেখানে বেড়াতে গিয়ে দেখেচি। আর কেউ দেখেনি। একসঙ্গে সবাই দেহ ধরে পৃথিবীতে এসেচি এ্যাডভেঞ্চারের জন্তে । সবাই, পৃথিবীমৃদ্ধ নরনারী একই সময়ে যারা পৃথিবীতে এসেচে–পরস্পরের আত্মীয়। তাদের উচিত পরস্পরকে