পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૭8 বিভূতি-রচনাবলী ভূষায়, কথাবাৰ্ত্তায় দাদা হয়ে গিয়েচে যেন কেমন! তেমনি ধরনের লোকের সমাজে সৰ্ব্বদা চলে ফেরে । রাত তখন প্রায় নট, দাদা ফিরে এসে রান্না চড়ালে। কি বিত্র জায়গাতেই থাকে। বাতাসার কারখানাটা একটা প্রকাও লম্বা চালাঘর—স্থ-সাতটা বড় বড় উচুনে দিনরাত গনগনে আগুন—বড় বড় কড়ায় গুড়ের রস আর চিনির রস তৈরি হচ্ছে । এই কারখানায় অত আগুনের তাতে থাকা কি দাদার অভ্যেস আছে কোনকালে ! দাদা নিজেই রান্না চড়ালে। আমায় বললে—খিচুড়ি খাবি জিতু ? বেশ ভাল মুগের ডাল আছে—উড়ে দেখি ঘি আছে বোধ হয় একটু— দাদার বাসা ছোট একখানা চালাঘর। মেঝের ওপর শোয়, বিছানা পাতাই থাকে, কোনকালে তোলা হয় না, তবে খুব ময়লা নয়—আমরা ক’ ভাইবোন ময়লা জিনিসপত্র মোটেই ব্যবহার করতে পারি নে, ছেলেবেলা থেকেই অভ্যেস। বিছানার ওপরকার কুলুঙ্গিতে খবরের কাগজ পাতা, একখানা ভাঙা পারা বার-হওয়া আর্শি, আর একখানা শিঙের চিরুনি । দাদা ছিল আমাদের মুধ্যে সব চেয়ে ছেলেমান্বষ, সব চেয়ে আনাড়ি, তাকে এখন নিজে রান্ন ক'রে খেতে হচ্ছে! অথচ কি-ই বা জানে ও সংসারের, কি কাজই বা পারে ? রান্না চড়িয়ে দাদা বললে—ভাল কথা, দাড়া জিতু, তোর জন্তে একখানা ইংরজি বই রেখে দিইচি–বের করে দিই— টিনের ছোট তোরঙ্গ খুলে একখানা মোটা ইংরিজি বই আমার হাতে দিয়ে বললে—এখানে সাতুবাবু কণ্টকটর আসে বাতাস নিতে, সে কেলে গিয়েছিল আর ফিরে আসেনি। আমি তুলে রেখে দিইচি, ভাবলাম জিতু পড়বে— পাতা উন্টে দেখি একটা বিলিতি স্টল কোম্পানীর মূল্যতালিকা—খুব চমৎকার পাত, চমৎকার ছাপ, বাড়িঘর, রেলের পুল, কড়িবরগার ছবিতে ভৰ্ত্তি। দাদার ওপরে দুঃখ হ'ল, বেচারি এ সব পড়তে পারে না, বুঝতেও পারে ন—ভেবেচে কি অপূৰ্ব্ব বই-ই না জানি। আমি কিছু না বলে বইখানা আমার পুটুলিতে বেঁধে নিলাম। দাদা ততক্ষণে তোরঙ্গ হাতড়ে আর একখানা ছোট ছেলেদের গল্পের বই বার ক'রে বললে—আর এই ছ্যাথ, একথান। বই, ভারি মঙ্গর মজার গল্প—আমি খেয়েদেয়ে রোজ একটুখানি করে পড়ি—খোড়া শিকারী'র গল্পটা পড়ছিলাম, পড় দেখি শুনি ? এসব গল্প ইংরজিতে কতবার পড়েচি, আমার কাছে এর নতুনত্ব নেই কোথাও । তবুও দাদাকে পড়ে পড়ে শোনাতে লাগলাম, দাদা মাঝে মাঝে খিচুড়িতে কাঠি দিয়ে দেখে, আর ইটু দুটো দুহাতে জড়িয়ে একটুখানি পেছনে হেলান দিয়ে বসে আমার মুখের দিকে আগ্রহের সঙ্গে চেয়ে চেয়ে শোনে। আমার এমন কষ্ট হ’ল ! এ-সব গল্প যে ইংরিজি স্কুলের নীচের ক্লাসের ছেলেরা ও জানে। আহা, দাদা বড় অভাগা, অল্প বয়সে সংসারের চাপ ঘাড়ে পড়ে সারাজীবনটা ওর নষ্ট হয়ে গেল । টাকার কথাটা দাদাকে বলতে মন চাইল না। ওর কত কষ্টে রোজগার করা পয়সা ; একটা আধটা নয়, ষোলট টাকা—এগারে টাকা মাসে মাইনে পায়—ওর দেড় মাসের রোজগার কোথা থেকে দেবে ও ? শৈলদির টাকা আমি এর পরে যে ক'রে হয় শোধ দেবো । দাদা নিজেই বললে—বাড়ি যাবি তো জিতু, গোটা দশেক টাকা নিয়ে যা । আমার বডড ইচ্ছে সীতাকে একছড়া হার গড়িয়ে দিই—কিন্তু টাকাই জমে না হাতে। তোর টাকার যদি