পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ w..ጳ জ্যাঠামশাই নিজের কথার প্রতিবাদ সহ করতে পারেন না—তিনি এ অঞ্চলের মানী ব্যক্তি, আগের চেয়ে বিষয়-আশয় টাকাকড়ি এখন তার আরও বেশী, এদিকের সব লোক তাকে খাতির করে চলে, কেনই বা তিনি প্রতিবাদ সহ করবেন ? সে জানি এ গায়ের রাম বাড়য্যের ব্যাপারে। রাম বাড়য্যে কি জন্তে রাত্রে আফিম খেয়ে শুয়েছিল—সকালে উঠে খবর পেয়ে জ্যাঠামশায় গেলেন। রাম বাড়য্যে ছিল জ্যাঠামশায়ের খাতক । জ্যাঠামশায় গিয়ে কড়া মুরে বললেন—কি হয়েচে রাম ? রাম বাড়য্যে তখন কথা বলতে পারচেন-জ্যাঠামশায়ের কথার উত্তর সে দিতে পারল না। জ্যাঠামশায় ভাবলেন, বাড়য্যে তার প্রতি অসম্মান দেখিয়ে ইচ্ছে করেই কথার উত্তর দিচ্চে না । বললেন—ভাল ক'রে কথার উত্তর দাও—কার সামনে কথা বলচ জান না ? সঙ্গের সব লোক বললে—ই, কৰ্ত্ত যা বলচেন, জবাব দাও ওঁর কথার । কিন্তু রাম বাড়য্যে জ্যাঠামশায়ের চোখরাঙানির চৌহদি পার হয়ে চলে গেল ঘণ্টী দুইয়ের মধ্যেই—কি জন্তে সে আফিম খেয়েছিল কেউ জানে নী—তার মৃত্যুর পরে জ্যাঠামশায় তার ভিটেমাটি বিক্ৰী ক’রে নিয়ে নিলেন—তার বিধবা স্ত্রী নাবালক একটি মাত্র মেয়ের হাত ধরে ভাইদের দোরে গিয়ে পড়লো। আমি যেবার ম্যাটিক দিই, সে বছরের কথা। আমার কথার উত্তরে জ্যাঠামশায় আমায় অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দিলেন। আমাদের এদিক নেই, ওদিক আছে । রাজামহারাজাদের ঘরে বোনের বিয়ে দেবার ইচ্ছে থাকলেই তো হয় না, পয়সা চাই। পনের-ষোল বছরের মেয়ে গ্রামে সমাজের মধ্যে বাস করতে গেলে আর ঘরে রাখা চলে না। তা ছাড়া তিনি কথা দিয়ে ফেলেচেন–র্তার কথার মূল্য আছে ইত্যাদি। জ্যাঠামশায়দের বাড়ির জীবনযাত্রার ধারা সেই পুরোনো দিনের মতই চলেচে। এখানে এলেই বুঝি, এদের মন নানা দিক থেকে কত ভাবে শৃঙ্খলিত। বাড়িতে এতটা জমি রয়েচে, ঠাকুরপুজার উপযোগী ছোট একখানা গাদা ও করবী ফুলের বাগান ছাড়া আর কোথাও একটা ফুলের গাছ নেই। উঠোনের কোন জায়গায় এরা কোথাও একটু সবুজ ঘাস রাখবে না— মেজকাকার কাজ হচ্চে এতটুকু কোথাও ঘাস গজালে তখনি নিজের হাতে নিড়েন ধরে উঠিয়ে ফেলা। প্রকাও উঠোন চাচাছোল, সাদা মাটি বার কর, সবুজের লেশ নেই। ব’লে দেখেচি এর তা বোঝে না । সামনের উঠোনটা লাউ-মাচা, পুই-মাচার ভরা—প্রত্যেক জায়গাটুকুতেই তরকারি লাগিয়েচে, নয়ত মান-কচুর ঝাড়। একদিন জ্যাঠামশায়ের ছেলে হারুদাকে বললাম—আমি শ্রীরামপুর থেকে ভাল মরসুমী বীজ এনে দেবো আর এক রকম লতা আছে আমাদের কলেজে, চমৎকার নীল ফুল ফোটে। বাড়ির সামনেট বাগান করো আর চণ্ডীমণ্ডপের চালে সেই লতা উঠিয়ে দাও— হারুদ বললে—তোমার যেমন বুদ্ধি, ফুলগাছে কি দুধ দেবে শুনি ? মিছিমিছি জায়গা জোড়া—চণ্ডীমণ্ডপের চালে ফি বছর ত্রিশ-চল্লিশখানা চালকুমড়া হয় জানিস তা ? অর্থাৎ আহারের আয়োজন হ'লেই হ’ল, আর কিছু দরকার নেই এদের । মেজকাকার ঘরে একদিন শুয়েছিলাম, কাকীমা এখানে নেই—মেজকাকার আবার একলা শুতে ভয় করে, তাই আমাকে শুতে বলেছিলেন । সারাদিন গরমের পরে অনেক রাত্রে এক পশলা বৃষ্টি হ’ল—কি মুন্দর ভিজেমাটির গন্ধ আসতে লাগল—মেজকাক দেখি উঠে তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করচেন | আমি বললাম—-বন্ধ করচেন কেন মেজকাকা, বেশ ভিজে হাওয়া আসচে— মেজকাকা বললেন—উহু, উন্থ–ঠাগু লাগবে—শেষরাতের বিষ্টির হাওয়া বড় খারাপ, কাল সর্দি ধরবে—আমার ধাতই একে সর্দির ।