পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ᎿᎸ বিভূতি-রচনাবলী , লেগেচে । ঘুসুড়ির সেই ষষ্ঠ মন্দিরের মত। কোন দেবতার কাছে নিমৰ্চাদের তিনটে টাকার ভোগ অর্ঘ্য গিয়ে পৌঁছুলো, জীবনের শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে পরম ত্যাগে সে যা নিবেদন করলে ? আর একটা কথা বুঝেচি। কাউকে কোন কথা বলে বুঝিয়ে বিশ্বাস করানো যায় না। মনের ধৰ্ম্ম মেজবাবু আমার কি শেখাবেন, আমি এটুকু জেনেচি নিজের জীবনে—মানুষের মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না সে জিনিসকে, যা ধরা-ছোয়ার বাইরের। আমি যা নিজের চোখে কতবার দেখলুম, বাস্তব বলে জানি—ঘরে-বাইরে সব লোক বললে ও মিথ্যে। পণ্ডিত ও মুখ এখানে সমান—ধরা-ছোয়ার গভীর সীমানা পার হয়ে কারুরু মন অন্তত অজানার দিকে পাড়ি দিতে চায় না। যা সত্যি তা কি মিথ্যে হয়ে যাবে ? কলকাতায় ফিরে এলাম বড়বাবুর মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে। জামাইকে বিয়ের রাত্রে বেবি অস্টিন গাড়ি যৌতুক দেওয়া হ’ল—বিবাহ মণ্ডপের মেরাপ বাধতে ও ফুল দিয়ে সাজাতেই ব্যয় হ'ল আটশ টাকা। বিয়ের পরে ফুলশয্যার তত্ত্ব সাজাতে আট-দশজন লোক হিমসিম খেয়ে গেল। ছোটবাবুর বন্ধুবান্ধবদের একদিন পৃথক ভোজ হ’ল, সেদিন শখের থিয়েটারে হাজার টাকা গেল এক রাত্রে। তবুও তো শুনলাম এ তেমন কিছু নয়—এরা পাড়াগায়ের গৃহস্থ জমিদার মাত্র, খুব বড়মাচুষি করবে কোথা থেকে। ফুলশয্যার তত্ত্ব সাজাতে খুব খাটুনি হ’ল। দু মণ দই, আধ মণ ক্ষীর, এক মণ মাছ, লরিবোঝাই তরিতরকারি, চল্লিশখান। সাজানো থালায় নানা ধরনের তত্ত্বের জিনিস—সব বন্দোবন্ত করে তত্ত্ব বার ক’রে ঝি-চকরের সারি সাজাতে ও তাদের রওনা করতে—সে এক রাজস্বয় ব্যাপার । ওদের রঙীন কাপড়-পরা ঝি-চাকরের লম্বা সারির দিকে চেয়ে মনে হ’ল এই বড়মানুষির থরচের দরুণ নিমৰ্চাদের স্ত্রী তিনটে টাকা দিয়েচে । অথচ এই হিমবর্ষী অগ্রহায়ণ মাসের রাত্রে হয়ত সে অনাথ বিধবার খেজুরডালের বীপে শীত আটকাচ্চে না, সেই যে বুড়ী যার গলা কাপছিল, তার সেই ধার-করে দেওয়া আট আনা পয়সা এর মধ্যে আছে। ধৰ্ম্মের নামে এর নিয়েচে, ওরা স্বেচ্ছায় হাসিমুখে দিয়েচে । সব মিথ্যে। ধর্মের নামে এরা করেচে ঘোর অধৰ্ম্ম ও অবিচারের প্রতিষ্ঠা। বটতলার গোসাই এদের কাছে ভোগ পেয়ে এদের বড়মানুষ ক'রে দিয়েচে, লক্ষ গরীব লোককে মেরে— জ্যাঠামশায়দের গৃহদেবতা যেমন তাদের বড় ক’রে রেখেছিল, মাকে, সীতাকে ও ভুবনের মাকে করেছিল ওদের ক্রীতদাসী । সত্যিকার ধৰ্ম্ম কোথায় আছে ? কি ভীষণ মোহ, অনাচার ও মিথ্যের কুহকে ঢাকা পড়ে গেছে দেবতার সত্য রূপ সেদিন, যেদিন থেকে এর হৃদয়ের ধৰ্ম্মকে তুলে অর্থহীন অনুষ্ঠানকে ধর্মের আসনে বসিয়েছে। দাদার একখানা চিঠি পেয়ে অবাক হয়ে গেলাম। দাদা যেখানে কাজ করে, সেখানে এক গরীব ব্রাহ্মণের একটি মাত্র মেয়ে ছিল, ওখানকার সবাই মিলে ধরে-পড়ে মেয়েটির সঙ্গে দাদার বিয়ে দিয়েচে । দাদা নিতান্ত ভালমানুষ, যে যা বলে কারও কথা ঠেলতে পারে না। কাউকে জানানো হয়নি, পাছে কেউ বাধা দেয়, তারাই জানাতে দেয়নি। এদিকে জ্যাঠামশায়ের ভয়ে বাড়িতে বেী নিয়ে যেতে সাহস করচে না, আমার লিখেচে, সে বড় বিপদে পড়েচে, এখন সে কি করবে চিঠির বাকী অংশটা নববধূর রূপগুণের উচ্ছ্বসিত মুখ্যাডিতে ভৰ্ত্তি।