পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ե8 বিভূতি-রচনাবলী কথার মধ্যে রাঢ় দেশের টান। মেয়েটি তারপর এসে দাওয়ায় দাড়াল। বয়স সাতাশআটাশ হবে, রং ফসর্ণ, হাতে টেমির আলোয় কপালের উল্কি দেখা যাচ্চে । মেয়েটি দাওয়ায় একটা মাদুর বিছিয়ে দিয়ে দিলে, এক ঘটি জল নিয়ে এল। আমি হাত পা ধুয়ে মুস্থ হয়ে বসলে মেয়েটি বললে—রান্নার কি যোগাড় ক’রে দেবো ঠাকুর ? আমি বললাম—আপনারা যা রাধবেন, তাই খাবো । রাত্রে দাওয়ায় শুয়ে রইলাম। পরদিন দুপুরের পরে অধিকারী মশাই এল। পেছনে জনতিনেক লোক, একজনের পিঠে একটা খোল বাধা । তামাক খেতে খেতে আমার পরিচয় নিলে, খুব খুশী হ’ল আমি এসেচি বলে। বিকেলে উদ্ধি-পরা স্ত্রীলোকটির সঙ্গে কি নিয়ে তার ঝগড়া বেধে গেল । স্ত্রীলোকটি বলচে শুনলাম—এমন যদি করবি মিন্সে, তবে আমি বলরামপুরে চলে যাব। কে তোর মুথনাড়ার ধার ধারে ? একটা পেট চলে যাবে ঢের, সেজন্তে তোর তোয়ক রাখি ভেবেচিস্তুই ! আগুনে জল পড়ার মত অধিকারীর রাগ একদম শান্ত হয়ে গেল। রাত্রে ওদের উঠোনে প্রকাণ্ড কীৰ্ত্তনের আসর বসল। রাত তিনটে পৰ্য্যন্ত কীৰ্ত্তন হ’ল। আসরসুদ্ধ সবাই হাত তুলে নাচতে শুরু করলে হঠাৎ । দু-তিন ঘণ্টা উদণ্ড নৃত্যের পরে ক্লাস্ত হয়ে পড়ার দরুনই হোক বা বেশী রাত হওয়ার জন্তেই হোক, তারা কীৰ্ত্তন বন্ধ করলে । আমি যেতে চাই, ওরা—বিশেষ ক’রে সেই স্ত্রীলোকটি—আমায় যেতে দের না । কি যত্ন সে করলে ! আরো একটা দেখলাম, অধিকারীকেও সেবা করে ঠিক ক্রীতদাসীর মত—মুখে এদিকে যখন-তখন যা-তা শুনিয়ে দেয়, তার মুখের কাছে দাড়াবার সাধ্যি নেই অধিকারীর । যাবার সময়ে মেয়েটি দিব্যি করিয়ে নিলে যে আমি আবার আসবে। বললে—তুমি তো ছেলেমানুষ, যখন খুশী আসবে। মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যাবে। তোমার খাওয়ার কষ্ট হচ্চে এখানে—মাছ মিলে না, মাংস মিলে না। বোশেখ মাসে এস, আম দিয়ে দুধ দিয়ে খাওয়াবো। কী সুন্দর লাগল ওর স্নেহ । আমার সেই দর্শনের ক্ষমতাটা ক্রমেই যেন চলে যাচ্চে। এই দীর্ঘ এক বছরের মধ্যে মাত্র একটিবার জিনিসটা ঘটেছিল। ব্যাপারটা যেন স্বপ্নের মত। তারই ফলে আটঘরায় ফিরে আসতে হচ্চে । সেদিন দুপুরের পরে একটি গ্রাম্য ডাক্তারের ডিসপেন্সারী-ঘরে বেঞ্চিতে শুয়ে বিশ্রাম করচি—ডাক্তারবাবু জাতিতে মাহিষ্ক, সৰ্ব্বদা ধৰ্ম্মকথা বলতে ও শুনতে ভালবাসে বলে আমায় ছাড়তে চাইত না, সব সময় কেবল ঘ্যান ঘ্যান ক'রে ওই সব কথা পেড়ে আমার প্রাণ অতিষ্ঠ ক'রে তুলেছিল— আমি ধৰ্ম্মের কথা বলতেও ভালবাসি না, শুনতেও ভালবাসি না—ভাবছি শুয়ে শুয়ে কাল সকালে এর এখান থেকে চলে যাব—এমন সময় একটু তন্দ্রী-মত এল । তন্দ্রঘোরে মনে হ’ল আমি একটা ছোট্ট ঘরের কুলুঙ্গি থেকে বেদান ভেঙে কার হাতে দিচ্চি, যার হাতে দিচ্চি সে তার রোগজীর্ণ হাত অতিকষ্টে একটু করে তুলে বেদান নিচ্চে, আমি যেন ভাল দেখতে পাচ্চি নে, ঘরটার মধ্যে ধোয়া-ধোয়া কুয়াশা—বারকতক এই রকম বেদানা দেওয়া-নেওয়ার পরে মনে হ’ল রোগীর মুখ আর আমার মাযের মুখ এক। তন্ত্রা ভেঙে মন অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠল এবং সেই দিনই সেখান থেকে আঠারো মাইল হেঁটে এসে ফুলসরা ঘাটে স্টীমার ধরে পরদিন বেলা দশটায় কলকাতা পৌঁছুলাম। মায়ের নিশ্চয়ই কোনো অসুখ করেচে, আটঘরা যেতেই হবে। শেয়ালদ’ স্টেশনের কাছে একটা দোকান থেকে আঙর কিনে নেবে। ভাবলাম, পকেটেও বেশী পয়লা নেই। পয়সা গুনচি দাড়িয়ে, এমন সময় দূর থেকে মেয়েদের বিশ্রাম ঘরের সামনে