পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ురి8 বিভূতি-রচনাবলী সে হঠাৎ শেষ-হইয়া-যাওয়া, কেমন যেন আধ-আধ, ভাঙা-ভাঙা ক্রিয়াপদযুক্ত এক ধরনের ভাষা, যাহা বিশেষ করিয়া মেয়েদের মুখে সাধারণত শোনা যায়—তাহার প্রতি আমার টান খুব বেশী। হঠাৎ আমি কবিকে বললাম—দয়া করে দুএকটা কবিতা পড়ুন না আপনার ? বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদের মুখ উৎসাহে উজ্জল দেখাইল । একটি গ্রাম্য প্রেম-কাহিনী লইয়া কবিতা লিথিয়াছে, সেটি পডিয়া শুনাইল । ছোট একটি খালের এ-পারের মাঠে এক তরুণ যুবক বসিয়া ভুট্টার ক্ষেত পাহারা দিত, খালের ওপারের ঘাটে একটি মেয়ে আসিত নিত্য কলসী-কাখে জল ভরিতে। ছেলেটি ভাবিত মেয়েটি বড় মুন্দর অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া শিস দিয়া গান করিত, ছাগল গরু তাডাইত, মাঝে মাঝে মেয়েটির দিকে চাহিয়া দেখিত । কত সময়ে দুজনের চোথাচোথি হইয়া গিয়াছে। অমনি লজ্জায় লাল হইয়া কিশোরী চোখ নামাইয়া লইত। ছেলেটি রোজ ভাবিত, কাল সে মেয়েটিকে ডাকিয়া কথা কহিবে। বাড়ী ফিরিয়া সে মেয়েটির কথা ভাবিত। কত কাল কাটিয়া গেল, কত ‘কাল’ আসিল, কত চলিয়া গেল—মনের কথা আর বলা হইল না । তার পর একদিন মেয়েটি আসিল না, পরদিনও আসিল না ; দিন, সপ্তাহ, মাস কাটিয়া গেল, কোথায় সে প্রতিদিনের সুপরিচিত কিশোরী ? ছেলেটি হতাশ হইয়া রোজ রোজ ফিরিয়া আসে মাঠ হইতে—ভীরু-প্রেমিক সাহস করিয়া কাহাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারে না—ক্রমে ছেলেটিকে দেশ ছাড়িয়া অঙ্গত্র চাকুরী লইতে হইল। বহুকাল কাটিয়া গিয়াছে। কিন্তু ছেলেটি সেই নদীর ঘাটের রূপসী বালিকাকে আজও ভুলিতে পারে নাই। দূরের নীল শৈলমাল ও দিগন্তবিস্তারী শস্তক্ষেত্রের দিকে চোখ রাখিয়া প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় এই কবিতাটি শুনিতে শুনিতে কত বার মনে হইল, এ কি বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদেরই নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ? কবি-প্রিয়ার নাম রুক্মা, কারণ ঐ নামে কবি একটি কবিতা লিথিয়াছে, পূৰ্ব্বে আমাকে তাহ শুনাইয়াছিল। ভাবিলাম এমন গুণবতী, স্বরূপ রুকুমাকে পাইয়াও কি কবির বাল্যের সে দুঃখ আজও দূর হয় নাই ? আমাকে তাবুতে পৌছিয়া দিবার সময়ে বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ একটি বড় বটগাছ দেখাইয়া বলিল—ঐ যে দেখছেন বাবুজী, ওর তলায় সেবার সভা হয়েছিল, অনেক কবি মিলে কবিতা পড়েছিল। এদেশে বলে মুসায়েরা। আমারও নিমন্ত্রণ ছিল। আমার কবিতা শুনে পাটনার ঈশ্বরীপ্রসাদ দুবে—চেনেন ঈশ্বরীপ্রসাদকে —ভারী এলেমদার লোক, ‘দূত, পত্রিকার সম্পাদক-নিজেও একজন ভাল কবি—আমার খুব খাতির করেছিলেন। কথা শুনিয়া মনে হইল বেঙ্কটেশ্বর জীবনে এই একবারই সভাসমিতিতে দাড়াইয়া নিজের কবিতা আবৃত্তি করিবার নিমন্ত্রণ পাইয়াছিল এবং সে দিনটি তাহার জীবনের একটা খুব বড় ও স্মরণীয় দিন গিয়াছে। এতবড় সন্মান আর কখনও সে পায় নাই।