পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক `ඵ মা ! মোটা সেলামী ও বদ্ধিত হারে খাজনার লোভে নূতন প্রজাদের সঙ্গেই বন্দোবস্ত করিতে চান। অথচ যে-সব গৃহহীন, আশ্রয়হীন অতিদরিদ্র পুরাতন প্রজাকে তাহদের স্তায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত করা হইয়াছে তাহারা বার বার অনুরোধ-উপরোধ কাল্পাকাটি করিয়াও জমি পাইতেছে না। আমার কাছেও অনেকে আসিয়াছিল । তাহদের অবস্থা দেখিলে কষ্ট হয়, কিন্তু জমিদারের হুকুম, কোনও পুরাতন প্রজকে জমি দেওয়া হইবে না। কারণ একবার চাপিয়া বসিলে তাহদের পুরাতন স্বত্ব তাহারা আইনত দাবী করিতে পারে। জমিদারের লাঠির জোর বেশী, প্রজার আজ বিশ বৎসর ভূমিহীন ও গৃহহীন অবস্থায় দেশে দেশে মজুরী করিয়া খায়, কেহ সামান্ত চাষবাস করে, অনেকে মরিয়া গিয়াছে, তাহদের ছেলেপিলেরা নাবালক বা অসহায়—প্রবল জমিদারের বিরুদ্ধে ম্রোতের মুখে কুটার মত ভাসিয়া যাইবে । এদিকে নূতন প্রজা সংগ্রহ করা যায় কোথা হইতে ? মুঙ্গের, পূর্ণিয়া, ভাগলপুর, ছাপরা প্রভৃতি নিকটবর্তী জেলা হইতে লোক যাহারা আসে, দুব শুনিয়া পিছাইয়া যায়। দু-পাচজন কিছু কিছু লইতেছেও। এইরূপ মৃদু গতিতে অগ্রসর হইলে দশহাজার বিঘা জঙ্গলী জমি প্রজাবিলি হইতে বিশ-পচিশ বৎসর লাগিয়া যাইবে । আমাদের এক ডিহি কাছারি আছে—সেও ঘোর জঙ্গলময় মহাল—এখান থেকে উনিশ মাইলে দূরে। জায়গাটার নাম লব টুলিয়া, কিন্তু এখানেও যেমন জঙ্গল, সেখানেও তেমনি, কেবল সেখানে কাছারি রাখার উদ্দেশ্য এই যে, সেই জঙ্গলটা প্রতি বছর গোয়ালাদের গরুমহিষ চরাইবার জন্য খাজনা করিয়া দেওয়া হয়। এ বাদে সেখানে প্রায় দু'তিনশ' বিঘা জমিতে বন্তকুলের জঙ্গল অ’ছে, লাক্ষ-কীট পুষিবার জন্য লোকে এই কুল-বন জমা লইয়া থাকে। এই টাকাটা আদায় করিবার জন্ত সেখানে দশ টাকা মাহিনীর একজন পাটোয়ারী ও তাহার একটা ছোট কাছারি অাছে । কুল বন ইজারা দিবার সময় আসিতেছে, একদিন ঘোড়া করিয়া লবটুলিয়াতে রওনা হইলাম। আমার কাছারি ও লবটুলিয়ার মাঝখানে একটা উচু রাঙামাটির ডাঙা প্রায় সাতআট মাইল লম্ব, এর নাম ‘ফুলকিয়া বইহার'—কত ধরণের গাছপালা ও ঝোপজঙ্গলে পরিপূর্ণ। জায়গায় জায়গায় বন এত ঘন যে, ঘোড়ার গায়ে ডালপালা ঠেকে। ফুলকিয়া বইহার যেখানে মামিয়া গিয়া সমতল ভূমির সহিত মিশিল, চানন বলিয়া একটি পাহাড়ী নদী সেখানে উপলখণ্ডের উপর দিয়া বিবুঝির করিয়া বহিতেছে, বর্ষাকালে সেখানে জল খুব গভীর— শীতকালে এখন তত জল নাই । * লবটুলিয়ায় এই প্রথম আসিলাম। অতি ক্ষুদ্র এক খড়ের ঘর, তার মেজে জমির সঙ্গে সমতল, ঘরের বেড়া পৰ্যন্ত শুকনে কাশের, বনঝাউয়ের ডালের পাতা দিয়া বাধা । সন্ধ্যার কিছু পূৰ্ব্বে সেখানে পৌছিলাম—এত শীত যেখানে থাকি সেখানে নাই, শীতে জমিরা যাইবার উপক্রম হইলাম বেলা না পড়িতেই। সিপাহীরা বনের ডালপাতা জালাইয়া আগুন করিল, সেই আগুনের ধারে ক্যাম্প-চেয়ারে,