পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>8 বিভূতি-রচনাবলী বসিলাম, অন্ত সবাই গোল হইয়া আগুনের চারিধারে বসিল । কোথা হইতে সের পাচেক একটা রুই মাছ পাটোয়ারী আনিয়াছিল, এখন কথা উঠিল, রান্না করিবে কে ? আমি সঙ্গে পাচক আনি নাই। নিজেও রান্না করিতে জানি না। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার জন্য সাত-আটজন লবটুলিয়াতে অপেক্ষা করিতেছিল—তাহাদের মধ্যে কণ্টমিশ্র নামে এক মৈথিল ব্রাহ্মণকে পাটোয়ারী রান্নার জন্ত নিযুক্ত করল। পাটোয়ারীকে বলিলাম-এ-সব লোকেই কি ইজারা ডাকবে ? r পাটোয়ারী বলিল—না হুজুর। ওরা খাবার লোভে এসেছে। আপনার আসবার নাম শুনে আজ দু-দিন ধরে কাছারিতে এসে বসে আছে । এদেশের লোকের ওই রকম অভ্যেস। আরও অনেকে বোধ হয় কাল আসবে। এমন কথা কখনও শুনি নাই । বলিলাম—সে কি ! আমি তো নিমন্ত্রণ করি নি এদের ? —হুজুর, এরা বড় গরীব ; ভাত জিনিসটা খেতে পায় না। কলাইয়ের ছাতু, মকাইয়ের ছাতু, এই এর বারোমাস খায়। ভাত খেতে পাওয়াটা এরা ভোজের সমান বিবেচনা করে । আপনি আসছেন, ভাত খেতে পাবে এখানে, সেই লোভে সব এসেছে। দেখুন না আরও কত আসে। বাংলা দেশের লোকে বড় বেশী সভ্য হইয়া গিয়াছে ইহাদের তুলনায়, মনে হইল। কেন জানি না । অন্নভোজনলোলুপ সরল ব্যক্তিগুলিকে আমার সে-রাত্রে এত ভাল লাগিল! আগুনের বসিয়া তাহারা নিজেদের মধ্যে গল্প করিতেছিল, আমি শুনিতেছিলাম । প্রথমে তাহার..."ামার আগুনে বসিতে চাহে নাই আমার প্রতি সন্মানসূচক দূরত্ব বজায় রাখিবার জন্ত—আমি তাহদের ডাকিয়া আনিলাম। কন্ট মিশ্র কাছে বসিয়াই আসীন কাঠের ডালপালা জালাইয়৷ মাছ রাধিতেছে—ধুনা পুড়াইবার মত মুগন্ধ বাহির হইতেছে ধোয়া হইতে —আগুনের কুণ্ডের বাহিরে গেলে মনে হয়, যেন আকাশ হইতে বরফ পড়িতেছে—এত শীত । খাওয়া-দাওয়া হইতে রাত হইয়া গেল অনেক ; কাছারিতে যত লোক ছিল, সকলেই খাইল। তারপর আবার আগুনের ধারে গোল হইরা বসা গেল। শীতে মনে হইতেছে শরীরের রক্ত পৰ্যন্ত জমিয়া যাইবে। ফাক বলিয়াই শীত বোধ হয় এত বেশী, কিংবা বোধ হয় হিমালয় বেশী দূর নয় বলিয়া । f আগুনের ধারে আমরা সাত আটজন লোক, সামনে ছোট ছোট দুখানি খড়ের ঘর। একখানিতে থাকিব আমি, আর একখানিতে বাকী এতগুলি । আমাদের চারদিকে ঘিরিয়া অন্ধকার বন ও প্রান্তর, মাথার উপরে নক্ষত্র-ছড়ানো দূরপ্রসারী অন্ধকার আকাশ। আমার বড় অদ্ভূত লাগিল, যেন চিরপরিচিত পৃথিবী হইতে নিৰ্ব্বাসিত হইয়া মহাশূন্তে এক গ্রহে অন্ত এক অজ্ঞাত রহস্যময় জীবনধারার সহিত জড়িত হইয়া পড়িয়াছি। একজন ত্রিশ-বত্রিশ বছরের লোক এ-দলের মধ্যে আমার মনোযোগকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করিয়াছিল । লোকটির নাম গনোরী তেওয়ারী ; শু্যামবর্ণ দোহার চেহারা, মাথায় বুড় চুল, কপালে দুটি লম্বা ফোট কাটা, এই শীতে গায়ে একখানা মোট চাদর ছাড়া আর