পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪০
বিরাজবৌ

হইয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল। কেবলই বলিতে লাগিল,—অন্তর্যামী ঠাকুর, একটিবার মুখ তুলে চাও। যে লোকে কোন দোষ, কোন পাপ করতে জানে না, তাকে আর কষ্ট দিও না ঠাকুর—আর আমি সইতে পারব না।

 রাত্রি তখন নটা বাজিয়া গিয়াছিল, নীলাম্বর নিঃশব্দে আসিয়া শয্যায় শুইয়া পড়িল। বিরাজ ঘরে ঢুকিয়া পায়ের কাছে বসিল। নীলাম্বর চাহিয়া দেখিল না, কথাও কহিল না।

 খানিক পরে বিরাজ স্বামীর পায়ের উপর একটা হাত রাখিতেই তিনি পা সরাইয়া লইলেন। আরও মিনিট পাঁচেক নিস্তব্ধে কাটিল—বিরাজের লুপ্ত অভিমান ধীরে ধীরে সজাগ হইয়া উঠিতে লাগিল, তথাপি সে মৃদুস্বরে বলিল, সমস্ত দিন যে খেলে না, এটা কার ওপর রাগ করে শুনি?

 ইহাতেও নীলাম্বর জবাব দিল না।

 বিরাজ বলিল, বল না শুনি?

 নীলাম্বর উদাসভাবে বলিল, শুনে কি হবে?

 বিরাজ বলিল, তবু শুনিই না।

 এবার নীলাম্বর অকস্মাৎ উঠিয়া বসিল, বিরাজের মুখের উপর দুই চোখ সতীক্ষ্ণ শূলের মত উদ্যত করিয়া বলিল, তোর আমি গুরুজন বিরাজ, খেলার জিনিস নয়।

 তাহার চোখের চাহনি, গলার শব্দ শুনিয়া বিরাজ সভয়ে চমকিয়া স্তব্ধ হইয়া গেল। এমন আর্ত, এমন গম্ভীর কণ্ঠস্বর সে ত কোন দিন শুনে নাই!


সাত

 মগ্‌রার গঞ্জে কয়েকটা পিতলের কবজার কারখানা ছিল। এ পাড়ার চাড়ালদের মেয়েরা মাটির ছাঁচ তৈরি করিয়া বিক্রি করিয়া আসিত। অসহ্য দুঃখের জ্বালায় বিরাজ তাহাদেরই একটি মেয়েকে ডাকিয়া ছাঁচ তৈরী করিতে শিখিয়াই লইয়াছিল। সে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী এবং অসাধারণ কর্মপটু, দু’দিনেই এ বিদ্যা আয়ত্ত করিয়া লইয়া সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট বস্তু প্রস্তুত করিতে লাগিল। ব্যাপারীরা আসিয়া এগুলি নগদ মূল্য দিয়া কিনিয়া লইয়া যাইত। রোজ এমনই করিয়া সে আট আনা উপার্জন করিতেছিল, অথচ, স্বামীর কাছে লজ্জায় তাহা প্রকাশ করিতে পারিত না। তিনি ঘুমাইয়া পড়িলে, অনেক রাত্রে নিঃশব্দে শয্যা হইতে উঠিয়া আসিয়া এই কাজ করিত। আজ রাত্রেও তাহাই করিতে আসিয়াছিল এবং ক্লান্তিবশতঃ কোন এক সময়ে সেইখানে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। নীলাম্বর হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গিয়া শয্যায় কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। বিরাজের হাতে তখনও কাদা মাখা, আশেপাশে